এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি আমলকী একাদশী মাহাত্ম্য, সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি আমলকী একাদশী ব্রত পালনের উদ্দেশ্য কি?
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
► আরও পড়ুন: পান্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প ও পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: অপরা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: শয়ন একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
আমলকী একাদশী ব্রত পালনের উদ্দেশ্য কী?
১) এই দিনে আমলকী ভক্ষণ, দর্শন, ও আমলকী বৃক্ষের তলে রাত্রি জাগরণ করতে হয়।
২) একাদশীর দিন আমলকী বৃক্ষের তলে রাত্রি জাগরণ করলে সহস্র গাভী দানের ফল লাভ হয়।
৩) এই বৃক্ষের স্মরণ মাত্র গো-দানের ফল, দর্শনে তাহার দ্বিগুণ এবং এর ফলভক্ষণে তিনগুণ ফল লাভ হয়। এই বৃক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর সর্বদা অবস্থান করেন। এর প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ও পাতায় ঋষি, দেবতা, ও প্রজাপতিগণ বাস করেন।
আমলকী একাদশী সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৯শে ফাল্গ ুন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ইং ১৪ই মার্চ ২০২২ সোমবার আমলকী একাদশী। ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারনঃ আমলকী একাদশীর পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সকাল ০৫:৫৯ থেকে ০৯:৪৮ মি: মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং সকাল ০৫:৩৬ থেকে ০৯:২৬ মি: মধ্যে কলকাতা, ভারত সময়। ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
আমলকী একাদশী সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
আমলকী একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
আমলকী একাদশী মাহাত্ম্য কথা
যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন― “হে অচ্যুত! হে দীনবন্ধু! মহাফলদাতা বিজয়া একাদশীর কথা শুনলাম। এখন ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি, এই একাদশীর মাহাত্ম্যই বা কি কৃপা করে আমায় বলুন। আমি তা জানতে অতি উৎসাহী।”
যুধিষ্ঠিরের আকুলতা দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যময় মুখে প্রসন্নতা ফুটে উঠল, তিনি বললেন― ‘হে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির! মান্ধাতার প্রশ্নের উত্তরে মহাত্মা বশিষ্ঠ মুনি এই একাদশীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন। আপনার কাছে এখন আমি সেই কথা বলছি, মনযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করুন। এই একাদশীর নাম ‘আমলকী’। বিষ্ণুলোক প্রদানকারী রূপে এই একাদশী বিশেষভাবে মহিমান্বিত। একাদশীর দিন আমলকী বৃক্ষের তলে রাত্রি জাগরণ করলে সহস্র গাভী দানের ফল লাভ হয়।
ভগবান আরও বললেন― ‘হে অজাতশত্রু! পূর্বে ব্রহ্মার রাত্রিকালে প্রলয় উপস্থিত হলে স্থাবর জঙ্গমসহ দেবতা, অসুর ও রাক্ষস সবকিছুর বিনাশ হয়। তখন শ্রীবিষ্ণু সেই কারণসমুদ্রে অবস্থান করছিলেন, সেইসময় তাঁর মুখপদ্ম থেকে চন্দ্রবর্ণের একবিন্দু জল ভূমিতে পড়ে। সেই জলবিন্দু থেকে একটি বিশাল আমলকী বৃক্ষ উৎপন্ন হয়। এই বৃক্ষের স্মরণ মাত্র গো-দানের ফল, দর্শনে তাহার দ্বিগুণ এবং এর ফলভক্ষণে তিনগুণ ফল লাভ হয়। এই বৃক্ষে ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর সর্বদা বাস করেন। এর প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ও পাতায় ঋষি, দেবতা, ও প্রজাপতিগণ অবস্থান করেন। এই বৃক্ষকে সমস্ত বৃক্ষের আদি হিসাবে গণ্য করা হয় এবং তা পরম বৈষ্ণব রূপে প্রসিদ্ধ। অতএব এই শ্রেষ্ঠ ব্রত সকলেরই পালন করা আবশ্যক। এখন এই ব্রতের একটি বিচিত্র ইতিহাস আপনার কাছে বর্ণনা করছি।
প্রাচীনকালে ‘বৈদিশ’ নামে এক প্রসিদ্ধ নগরে ‘চৈত্ররথ’ নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। চৈত্ররথ ছিলেন চন্দ্রবংশীয় পাশবিন্দুক রাজার পুত্র। তিনি অত্যন্ত শক্তিমান, বলশালী ও ঐশ্বর্যশালী ছিলেন। শাস্ত্রজ্ঞানেও তিনি ছিলেন দক্ষ ও সুনিপুন। তার রাজ্যের সর্বত্রই মনোরম আনন্দপূর্ণ এক দিব্য পরিবেশ পরিলক্ষিত হত। তার রাজ্যের প্রজারা ছিল বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ এবং সকলেই ভগবানের উদ্দেশ্যে একাদশী ব্রত পালন করতেন। তার রাজ্যে কোন অভাব অমঙ্গলের চিহ্ন বিন্দুমাত্র ছিল না। সুখী প্রজাদের নিয়ে রাজা চৈত্ররথ আনন্দে দিনযাপন করতে থাকেন।
একসময় ফাল্গুনী শুক্লপক্ষের দ্বাদশীযুক্তা আমলকী তিথি আগত হলে সকল রাজ্যবাসীরা এই ব্রত পালনের সংকল্প নিলেন। ঐদিন প্রাতঃ স্নান সেরে প্রজাদের নিয়ে তিনি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরে গমন করেন। সেখানে সুবাসিত জলপূর্ণ কলস, ছত্র, বস্ত্র, পাদুকা, পঞ্চরত্ন প্রভৃতি দিয়ে সুসজ্জিত করেন। তারপর ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে অতিযত্ন সহকারে মুনি-ঋষিদের দ্বারা শ্রীপরশুরাম মূর্তি সমন্বিত আমলকীর পূজা শুরু করেন। ‘হে পরশুরাম! হে রেণুকার সুখবর্ধক! হে ধাত্রি! হে পাপবিনাশিনী আমলকী! আপনাকে অনন্ত প্রণাম। আমার অর্ঘ্যজল গ্রহণ করুন।’ এইভাবে দিনের বেলায় যথাবিধি পূজা স্তবস্তুতি ভজন কীর্তন নৃত্যগীত করে রাজা ভক্তিভরে সেই বিষ্ণুমন্দিরে রাত্রি জাগরণ করতে লাগলেন।
এমন সময় দৈবক্রমে এক ব্যাধ সেখানে উপস্থিত হয়। পূজার সামগ্রী সহ বহু ব্যক্তিকে একত্রে রাত্রি জাগরণ করতে দেখে সে অত্যন্ত কৌতূহলী হন। সে বারবার ভাবতে লাগল ― এসব কি ব্যাপার? এখানে কিসের এত আয়োজন? কৌতূহল বশত বিষ্ণু মন্দিরে প্রবেশ করে সেখানে বসে পড়ল। কলসের উপরে স্থাপিত বিষ্ণুমূর্তি দর্শন করল। ভগবান বিষ্ণু এবং একাদশীর মাহাত্ম্যও সে মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করল। সারাদিন ঐ ব্যাধ কিছুই আহার করেনি। এইভাবে ক্ষুধায় কাতর হয়ে সেখানে সে রাত্রি জাগরণ করল।
পরদিন প্রজাসহ রাজা নগরের দিকে যাত্রা করলেন। সেই ব্যাধও তার গৃহে ফিরে গেল। এরপর সেই ব্যাধের মৃত্যু হল। একাদশীতে রাত্রি জাগরণ ব্রতের পুণ্যফলে সেই ব্যাধ পরবর্তী জন্মে এক নগরীর অধীশ্বর যোগ নিয়ে জন্ম নিল।
সেইসময় ‘জয়ন্তী’ নামে এক নগরীতে ‘বিদূরথ’ নামে এক রাজা শাসন করতেন। ঐ ব্যাধ বিদূরথ রাজার মহাবলী পুত্র ‘বসুরথ’ নামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরক্রমতার কারনে তিনি এক লক্ষ গ্রামের আধিপত্য লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সদ্গুণে ভূষিত ছিলেন, সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সূর্যের মত তেজস্বী, চন্দ্রের মত কান্তিমান ও পৃথিবীর মতো ক্ষমাশীল। পূর্বজন্মের ব্রতের সুকৃতির ফলে তিনি পরম বিষ্ণুভক্তি পরায়ণ হন।
এই মহাদাতা রাজা একবার শিকার করতে গিয়ে পথ ভুলে যান। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ক্ষুধায় পীড়িত ও ক্লান্ত হয়ে একগাছতলে শুয়ে পড়েন। এমন সময় কতগুলি পর্বতনিবাসী ম্লেচ্ছ (বর্বর অসভ্য জনজাতি) রাজার কাছে এসে নানাভাবে উৎপীড়ন করতে থাকে। ”পূর্বে এই রাজা আমাদের পিতা-মাতা, পুত্র-পৌত্র সবাইকে মেরে ফেলেছে। আমাদের গৃহছাড়া করেছে।” ―এইকথা বলতে বলতে ম্লেচ্ছরা রাজাকে অযথা শত্রু মনে করে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে রাজাকে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল তাদের সকল প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে রাজার কোন ক্ষতি হয় না। সেইসময় রাজার শরীর থেকে নানা অলঙ্কারে বিভূষিতা এক পরমা সুন্দরী দিব্য নারী মূর্তি আবির্ভূতা হন। মহাশক্তিধারিনী ঐ দিব্য নারী অল্প সময়ের মধ্যেই সকল পাপী ম্লেচ্ছকে নিধন করে। ইতিমধ্যে রাজার নিদ্রাভঙ্গ হলে তিনি এমন ভয়ানক নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হন।
তিনি চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন এবং আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলেন ―’এখানে এমন কৃপালু কে আছে যিনি আমার শত্রুদের হত্যা করে আমার প্রাণ রক্ষা করল? আমি সেই মহাত্মাকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’
এমন সময়ে দৈববাণী হল― ‘ভগবান কেশব ব্যতীত শরণাগতকে রক্ষা করার জন্য আর কে আছে? তিনিই শরণাগত পালক ও রক্ষক।’ দৈববাণী শুনে ভগবানের প্রতি বৈরাগ্য আরও বেড়ে গেল, প্রণাম সেরে ভক্তিযুক্ত চিত্তে নগরীতে ফিরে এলেন। তারপর প্রজাসহ মহাসুখে ইন্দ্রের মতো নিষ্কণ্টক রাজ্যসুখ ভোগ করতে লাগলেন।
বশিষ্ঠ মুনি মান্ধাতাকে আরও একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন― ‘হে রাজন! যে মানুষ এই পরম-উত্তম আমলকী একাদশী ব্রত পালন করেন তিনি নিঃসন্দেহে বিষ্ণুলোক প্রাপ্ত হন।’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত অমৃতময় ব্রত কথা শুনে যুধিষ্ঠির মহারাজ ধন্য হলেন। পরম্পরাক্রমে সেই ব্রত কথা আজও প্রচলিত এবং এভাবেই ভক্তগনেরা ভগবানের কৃপায় মুক্তিলাভ করে চলেছে।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
You must be logged in to post a comment.