এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি উত্থান একাদশী মাহাত্ম্য (Uthani Ekadashi / Utthana Ekadashi), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
এই একাদশী প্রবোধিনী একাদশী (Prabodhini Ekadashi) নামেও পরিচিত।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি উত্থান একাদশী ব্রত (Uthani Ekadashi Vrat/ Utthana Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
উত্থান একাদশী / প্রবোধিনী একাদশী ব্রত পালনের উদ্দেশ্য কি?
১) উত্থান একাদশী পাপনাশিনী, পুণ্যকারী ও মুক্তি প্রদানকারী। এই ব্রতের প্রভাবে পর্বত সমান পাপরাশি বিনষ্ট হয়।
২) এই ব্রত নিষ্ঠা সহকারে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। ঐশ্বর্য, প্রজ্ঞা, রাজ্য ও সুখ লাভ হয়।
৩) হরিবাসরে (একাদশীতে) রাত্রি জাগরণ করলে তাদের সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়। শ্রেষ্ঠ মুনিগণ তপস্যার দ্বারা যে ফল লাভ করে, এই ব্রতের উপবাসে সেই সমান ফল প্রাপ্ত হয়।
৪) এই একাদশীর ধ্যান করলে সেই ব্যাক্তির পূর্বপুরুষেরা স্বর্গে আনন্দে বাস করে।
৫) এই একাদশী উপবাসের পুণ্যফলে ব্রহ্মহত্যা জনিত ভয়ঙ্কর নরক যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেয়ে বৈকুণ্ঠগতি লাভ হয়।
৬) সমস্ত লৌকিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ভক্তি সহকারে এই ব্রত পালন করলে তাকে আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। এমনকি মন ও বাক্য দ্বারা অর্জিত পাপরাশিও শ্রীবিষ্ণুর অর্চনে বিনষ্ট হয়।
৭) অশ্বমেধ যজ্ঞতে যে ফল লাভ হয় না এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই পুণ্যফল অনায়াসে লাভ হয়। তীর্থে স্বর্ণ প্রভৃতি দান করলে যে পুণ্য অর্জিত হয় এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই সকল অনায়াসে লাভ হয়।
৮) নিষ্ঠা ও ভক্তিভাব সহকারে উত্থান একাদশী অনুষ্ঠান করলে গৃহে ত্রিভুবনের সমস্ত তীর্থ এসে উপস্থিত হয়।
৯) এই ব্রতে শ্রদ্ধা সহকারে শ্রী জনার্দনের উদ্দেশ্যে স্নান, দান, জপ, কীর্তন ও হোমাদি করলে অক্ষয় লাভ হয়। তীর্থে স্নান, দান, জপ, হোম, ধ্যান আদির ফলে যে পুণ্য সঞ্চিত হয়, উত্থান একাদশী পালন না করলে সে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যায়। শ্রী হরিবাসরে (একাদশীতে) শ্রী জনার্দনের পূজা বিশেষ ভক্তি সহকারে না করলে শতজন্মার্জিত পুণ্য বিফল হয়।
১০) সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করলে যে পুণ্য হয়, উত্থান একাদশীতে শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে অর্ঘ্য (পূজার উপকরণ) অর্পণে তার কোটি গুন সুকৃতি লাভ হয়।
১১) শ্রবণ কীর্তন, স্মরণ বন্দনাদি নববিধা ভক্তির সাথে তুলসীর সেবার উদ্দেশ্যে যারা তুলসী বীজ রোপণ, জল সেচন ইত্যাদি করেন, তারা মুক্তি লাভ করে বৈকুণ্ঠবাসী হন।
উত্থান একাদশী / প্রবোধিনী একাদশী – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৩ নভেম্বর ২০২৩ বৃহস্পতিবার উত্থান একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : উত্থান একাদশীর পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৬:১৮ থেকে ০৯:৫৬ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৫:৫৭ থেকে ০৯:৩৫ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
উত্থান একাদশী / প্রবোধিনী একাদশী – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
উত্থান একাদশী / প্রবোধিনী একাদশী – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে
আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
উত্থান একাদশী / প্রবোধিনী একাদশী – মাহাত্ম্য কথা
কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী মাহাত্ম্য স্কন্দপুরাণে ‘ব্রহ্মা-নারদ সংবাদে’ সুন্দরভাবে বর্ণিত রয়েছে।
এই ব্রত সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে পুরুষোত্তম! হে দেব যদুবর! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি এবং এ একাদশীর মাহাত্ম্যই বা কি? কৃপা করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করুন। আমি তা শুনতে অত্যন্ত ব্যাকুল ও আগ্রহী।”
মহারাজের ব্যাকুলতা বারবার দেখেছেন, এবারও তার অন্যথা হল না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন চিত্তে স্মিত হেসে বললেন, “হে কৌন্তেয়! হে রাজন! কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী ‘উত্থান’ বা ‘প্রবোধিনী‘ নামে প্রসিদ্ধ। প্রজাপতি ব্রহ্মা সর্বপ্রথম দেবর্ষি নারদের কাছে এই একাদশীর মহিমা কীর্তন করেছিলেন। এখন তুমি আমার কাছে সেই কথা একাগ্র চিত্তে শ্রবণ কর।
একদিন দেবর্ষি নারদ প্রজাপতি ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে মহাত্মা! যে একাদশীতে ভগবান শ্রী গোবিন্দ শয়ন থেকে জেগে ওঠেন, সেই একাদশীর মাহাত্ম্য আমার কাছে সবিস্তারে বর্ণনা করুন।’
ব্রহ্মা বললেন, ‘হে দেবর্ষি! উত্থান একাদশী যথার্থই পাপনাশিনী, পুণ্যকারী ও মুক্তি প্রদানকারী। এই ব্রত নিষ্ঠা সহকারে পালন করলে এক হাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও শত শত রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। জগতের দুর্লভ বস্তুর প্রাপ্তির জন্য এই একাদশী ব্রত অনবদ্য। এই একাদশী নিষ্ঠাবান ভক্তকে (ভক্তি পরায়ন ব্যক্তিকে) ঐশ্বর্য, প্রজ্ঞা, রাজ্য ও সুখ প্রদান করে। এই ব্রতের প্রভাবে পর্বত সমান পাপরাশি বিনষ্ট হয়।
যে ভক্তগন হরিবাসরে (একাদশীতে) রাত্রি জাগরণ করেন, তাদের সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়। শ্রেষ্ঠ মুনিগণ তপস্যার দ্বারা যে ফল লাভ করে, এই ব্রতের উপবাসে সেই সমান ফল প্রাপ্ত হয়। সুতরাং যথাযথ ভাবে এই ব্রত পালনে আশাতীত ফল লাভ হয়। কিন্তু অনিয়ম করে উপবাস করলে স্বল্পমাত্র ফল লাভ হয়।
যে ভক্তগন এই একাদশীর ধ্যান করে, তাদের পূর্বপুরুষেরা স্বর্গে আনন্দে বাস করে। এই একাদশী উপবাসের পুণ্যফলে ব্রহ্মহত্যা জনিত ভয়ঙ্কর নরক যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেয়ে বৈকুণ্ঠগতি লাভ হয়। হে নারদ! এই একাদশী উপবাসের ফলে সর্ব শাস্ত্রে জ্ঞান ও তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে চরমে মুক্তি লাভ হয়। যিনি সমস্ত লৌকিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ভক্তি সহকারে এই ব্রত পালন করেন তাকে আর পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয় না। এমনকি মন ও বাক্য দ্বারা অর্জিত পাপরাশিও শ্রীবিষ্ণুর অর্চনে বিনষ্ট হয়।
অশ্বমেধ যজ্ঞ দ্বারাও যা সহজে লাভ হয় না এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই সকল অনায়াসে লাভ হয়। তীর্থে স্বর্ণ প্রভৃতি দান করলে যে পুণ্য অর্জিত হয় এই উপবাসের রাত্রি জাগরণে সেই সকল অনায়াসে লাভ হয়।
যে ব্যাক্তি সঠিক ভাবে নিষ্ঠা ও ভক্তিভাব সহকারে উত্থান একাদশী অনুষ্ঠান করেন, তার গৃহে ত্রিভুবনের সমস্ত তীর্থ এসে উপস্থিত হয়।
হে বৎস! এই ব্রতে শ্রদ্ধা সহকারে শ্রী জনার্দনের উদ্দেশ্যে স্নান, দান, জপ, কীর্তন ও হোমাদি করলে অক্ষয় লাভ হয়। যারা উপবাস দিনে শ্রী হরির প্রতি ভক্তি সহকারে দিন যাপন করেন, তাদের পক্ষে জগতে দুর্লভ বলে আর কিছু নেই। চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণে স্নান করলে যে পুণ্য হয়, এই উপবাসে রাত্রি জাগরণ করলে তার সহস্র গুন সুকৃতি লাভ হয়। তীর্থে স্নান, দান, জপ, হোম, ধ্যান আদির ফলে যে পুণ্য সঞ্চিত হয়, উত্থান একাদশী পালন না করলে সে সমস্ত নিষ্ফল হয়ে যায়। হে নারদ! শ্রী হরিবাসরে (একাদশীতে) শ্রী জনার্দনের পূজা বিশেষ ভক্তি সহকারে না করলে শতজন্মার্জিত পুণ্য বিফল হয়।
সমস্ত তীর্থ ভ্রমণ করলে যে পুণ্য হয়, উত্থান একাদশীতে শ্রীকৃষ্ণ পাদপদ্মে অর্ঘ্য (পূজার উপকরণ) অর্পণে তার কোটি গুন সুকৃতি লাভ হয়। শ্রবণ কীর্তন, স্মরণ বন্দনাদি নববিধা ভক্তির সাথে তুলসীর সেবার উদ্দেশ্যে যারা তুলসী বীজ রোপণ, জল সেচন ইত্যাদি করেন, তারা মুক্তি লাভ করে বৈকুণ্ঠবাসী হন।
হে বৎস! যিনি কার্তিক মাসে সর্বদা ভাগবত শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে সমস্ত যজ্ঞের ফল লাভ করেন। ভগবান শ্রীহরি ভক্তিমূলক শাস্ত্রপাঠে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন, কিন্তু দান, জপ, যজ্ঞাদি দ্বারা তিনি তেমন প্রীত হন না। এই মাসে শ্রী বিষ্ণুর নাম, গুন, রূপ, লীলাদি শ্রবণ কীর্তন অথবা শ্রীমদ্ভাগবত আদি শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠের ফলে শত শত গোদানের ফল লাভ করা যায়।
অতএব হে মুনিবর! কার্তিক মাসে সমস্ত গৌণধর্ম বর্জন করে শ্রীবিষ্ণুর সামনে হরিকথা শ্রবণ কীর্তন করা কর্তব্য। কোনো ব্যক্তি যদি ভক্তি সহকারে এই মাসে ভক্তসঙ্গে হরিকথা শ্রবণ কীর্তন করেন, তবে তার শতকুল উদ্ধার হন এবং হাজার হাজার দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল অনায়াসে লাভ হয়। এই মাসে পবিত্র ভাবে শ্রীকৃষ্ণের রূপ গুনাদির শ্রবণ কীর্তনে দিন যাপন করলে তার আর পুনর্জন্ম হয় না। এই মাসে বহু ফলমূল, ফুল, অগুরু, কর্পূর ও চন্দন দিয়ে শ্রী হরির পূজা করা অত্যন্ত কর্তব্য।
হে নারদ! সহস্র সুগন্ধি পুষ্পে দেবতার অর্চনে বা সহস্র সহস্র যজ্ঞ ও দানে যে সুফল লাভ হয়, এই কার্তিক মাসে হরিবাসরে একটি মাত্র তুলসী পাতা শ্রী ভগবানের চরণ কমলে অর্পণ করলে তার থেকে অনন্ত কোটি বেশি গুন সুফল লাভ হয়।”
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.