এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য (Utpanna Ekadashi), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি উৎপন্না একাদশী ব্রত (Utpanna Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
কোনো এক একাদশী তিথিতে শ্রীবিষ্ণুর পরাশক্তি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল উৎপন্না একাদশী।
উৎপন্না একাদশী ব্রত পালনের উদ্দেশ্য কি?
● যারা এই একাদশী ব্রত পালন করবে ব্রত পালনকারীর সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হবে, তাদের সকল মনোবাসনা পূর্ণ হবে।
● উৎপন্না একাদশীর আবির্ভাব যেহেতু শ্রীবিষ্ণুর পরাশক্তি থেকে, তাই এই ব্রত পালনকারী সকলে ভগবানেরই পূজা করে থাকেন। এর ফলে প্রত্যেক ব্রত পালনকারী ভগবানের কৃপায় মুক্তি লাভ করবে।
● এই ব্রতপালনকারীর শত্রূবিনাশ হয়, পরমগতি এবং সর্বসিদ্ধি লাভ হয়।
উৎপন্না একাদশী (Utpanna Ekadashi) – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার উৎপন্না একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২২ অগ্রহায়ন ১৪৩০।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : উৎপন্না একাদশীর পরদিন অর্থাৎ রবিবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৬:২৯ থেকে ০৭:৪৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৬:০৪ থেকে ০৭:১৫ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
উৎপন্না একাদশী (Utpanna Ekadashi) – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
উৎপন্না একাদশী (Utpanna Ekadashi) – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে
আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
উৎপন্না একাদশী মাহাত্ম্য কথা
এই ব্রত সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্যে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে হৃষীকেশ! হে যোগেশ্বর! অগ্রহায়ণের পুণ্যপ্রদায়ী কৃষ্ণপক্ষের একাদশীকে কি কারনে ‘উৎপন্না’ বলা হয়, কিসের জন্য এই একাদশী পরম পবিত্র ও কেনই বা এই ব্রত দেবতাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়, তা জানতে আমি অত্যন্ত কৌতুহলী। আপনি কৃপা করে আমাকে তা সবিস্তারে বর্ণনা করুন।”
সখার ব্যাকুলতা দেখে শ্রীভগবান প্রসন্ন হয়ে বললেন, “হে পার্থ! হে গুড়াকেশ! পূর্বে সত্যযুগে ‘মুর’ নামে এক দানব ছিল। বিকট আকৃতিবিশিষ্ট সেই দানব ছিল অত্যন্ত ক্রোধী। তার প্রতাপে দেবতারাও ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। তার উপর সে মহাদেবের কাছ থেকে বর পেয়েছিল যে ‘কোন অস্ত্রে তার পরাজয় হবে না, এমনকি ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রেও না।’ তখন মুর দানব এই বর পেয়ে আরও পরাক্রমি হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধে স্বর্গরাজ ইন্দ্রসমেত বাকি দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ জয় করে দেবতাদের বিতারিত করে।
সেই কারনে দেবতারা পৃথিবীতে বিচরণ করতে বাধ্য হয়। তখন দেবতারা মহাদেবের কাছে উপস্থিত হয়ে নিজেদের সমস্ত দু:খ সবিস্তারে জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। শুনে চিন্তিত মহাদেব বললেন, ‘হে দেবরাজ! আমি তাকে বর দিয়েছি, আমিই তাকে বধ করতে পারব না। আপনারা ভগবান বিষ্ণুর স্মরনাপন্ন হন, এই সঙ্কটকালে তিনিই কেবল আপনাদের সাহায্য করতে পারবেন। যেখানে শরণাগতবৎসল জগন্নাথ, গরুধ্বজ বিরাজ করছেন, তোমরা সেখানে যাও। তিনি আশ্রিতদের পরিত্রাণকারী। তিনি নিশ্চয়ই তোমাদের মঙ্গল বিধান করবেন।’
দেবাদিদেবের কথামতো দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদের নিয়ে ক্ষীরসমুদ্রের তীরে গমন করলেন। জলে শায়িত শ্রীবিষ্ণুকে দর্শন করে দেবতারা হাত জোড় করে তাঁর স্তব করতে লাগলেন এবং একে একে নিজ নিজ দৈন্য ও দু:খের কথা ভগবানকে খুলে বললেন।
ইন্দ্রের কথা শুনে ভগবান শ্রীবিষ্ণু বললেন, ‘হে ইন্দ্র! সেই মুর দানব কি রকম, সে কেমন শক্তিশালী, তা আমায় বল।’
ইন্দ্র বললেন, ‘হে ভগবান! প্রাচীনকালে ব্রহ্ম বংশে তালজঙ্ঘা নামক এক অতি পরাক্রমী অসুর ছিল। তারই পুত্র হল মুর যে অত্যন্ত বলশালী, পরাক্রমী ও দেবতাদের কাছে ত্রাসের কারন। সে চন্দ্রাবতী নামে এক পুরীতে বাস করে। স্বর্গ থেকে আমাদের বিতাড়িত করে তার স্বজাতি দানবদের কাউকে রাজা, কাউকে অন্যান্য দিকপালরূপে প্রতিষ্ঠিত করে এখন সে দেবলোক সম্পূর্ণ অধিকার করেছে। তার প্রবল বিক্রমে আজ আমরা পৃথিবীতে উদ্ভ্রান্তের মতো বিচরণ করছি।’
ইন্দ্রদেবের কথা শুনে ভগবান অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি দেবতাদের সঙ্গে চন্দ্রাবতী পুরীতে গেলেন। শ্রীবিষ্ণুকে দেখামাত্রই দৈত্যরাজ মুর বারবার তর্জন-গর্জন করতে লাগল। দেবতা ও অসুরের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। শ্রীভগবান অসুরপক্ষের সমস্ত যোদ্ধাদের দিব্য বাণের আঘাতে হত্যা করতে লাগলেন। তখন তারা প্রাণবাঁচাতে নানা দিকে পালাতে লাগল। সেই সময় শ্রীবিষ্ণু দৈত্য সৈন্যদের হত্যার জন্য সুদর্শন চক্র নিক্ষেপ করলেন। ফলে সমস্ত সৈন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। একমাত্র মুর অসুরই জীবিত রইল। তখন শ্রীবিষ্ণু মুরের সাথে বাহুযুদ্ধে লিপ্ত হলেন।
এইভাবে দেবতাদের হিসাবে এক হাজার বছর যুদ্ধ করার পরেও তার মৃত্যু কোন অস্ত্রেই হল না। তখন শ্রীহরি বিশেষ চিন্তান্বিত হয়ে বদরিকা আশ্রমে গমন করলেন। সেখানে সিংহাবতী নামে একটি গুহার মধ্যে প্রবেশ করে শয়ন করলেন। এই গুহাটি এক-দ্বার বিশিষ্ট এবং বারোযোজন অর্থাৎ ৮৬ মাইল বিস্তিৃত। মুর দানব ভগবানের পিছু পিছু সেই গুহায় প্রবেশ করল। সে শ্রীবিষ্ণুকে নিদ্রিত দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে ভাবতে লাগল, আমার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিষ্ণু এখানে গোপনে শুয়ে আছে। এখন আমি তাকে অবশ্যই বধ করব। দানবের এইরকম চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর শরীর থেকে এক নারীমুর্তির আবির্ভাব ঘটল।
তিনি হলেন ‘উৎপন্না’ একাদশী। তিনি রূপবতী, সৌভাগ্যশালিনী, দিব্য অস্ত্র-শস্ত্রধারিনী ও বিষ্ণু তেজসম্ভুতা বলে মহাপরাক্রমশালী ছিলেন। দৈত্যরাজ মুরের সাথে তার তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। কিছুকাল যুদ্ধের পর দেবীর দিব্য তেজে অসুর ভস্মীভূত হল।
তারপর শ্রীবিষ্ণু জেগে উঠে সেই ভস্মীভূত দানবকে দেখে বিস্মিত হলেন। এক দিব্যনারীকে তাঁর পাশে হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘হে মহাপরাক্রান্ত উগ্রমূর্তি! এই মুর দানবকে কে বধ করল? যিনি একে হত্যা করেছে তিনি নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় কর্ম করেছে।’
সেই দিব্যনারী বললেন, ‘হে প্রভু! আমি আপনার শরীর থেকে উৎপন্ন হয়েছি। আপনি যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন এই দানব আপনাকে বধ করতে চেয়েছিল। তাই দেখে আমি তাকে বধ করেছি। আপনার কৃপাতেই আমি তাকে বধ করতে পেরেছি।’
একথা শুনে ভগবান বললেন, ‘তুমি একাদশীতে আমার পরাশক্তি থেকে উৎপন্ন হয়েছ। তাই তোমার নাম হবে উৎপন্না একাদশী। আমি এই ত্রিলোকে দেবতা ও ঋষিদের অনেক বর প্রদান করেছি। হে ভদ্রে! তুমি দেবতাদের রক্ষা করেছ, তুমিও তোমার মনমতো বর প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে তা প্রদান করব।’
একাদশী বললেন, ‘হে দেবেশ! ত্রিভুবনের সর্বত্র আপনার কৃপায় সর্ববিঘ্ননাশিনী ও সর্বদায়িনী রূপে যেন পরম পুজ্য হতে পারি, এ বিধান করুন। আপনার প্রতি ভক্তিবশত: যারা শ্রদ্ধাসহকারে আমার ব্রত-উপবাস করবে, তাদের সর্বসিদ্ধি লাভ হবে এই বর প্রদান করুন।’
ভগবান শ্রীবিষ্ণু প্রসন্ন হয়ে বললেন, ‘হে কল্যাণী! তাই হোক। ‘উৎপন্না’ নামে প্রসিদ্ধ তোমার ব্রত পালনকারীর সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হবে। তুমি তাদের সকল মনোবাসনা পূর্ণ করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। তোমাকে আমার শক্তি বলে মনে করি। তাই তোমার ব্রত পালনকারী সকলে আমারই পূজা করবে। এর ফলে তারা মুক্তি লাভ করবে। তুমি হরিপ্রিয়া নামে জগতে বিখ্যাত হবে। তুমি ব্রতপালনকারীর শত্রূবিনাশ, পরমগতি দান এবং সর্বসিদ্ধি প্রদান করতে সমর্থ হবে।’
ভগবান বিষ্ণু এইভাবে ‘উৎপন্না’ একাদশীকে বরদান করে অন্তর্হিত হলেন। সমস্ত ব্রতকারী দিবারাত্রি ভক্তিপরায়ণ হয়ে এই উৎপন্না একদশীর উৎপত্তির কথা শ্রবণ-কীর্তন করলে শ্রীহরির আশীর্বাদ লাভে ধন্য হবেন।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.