এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি কামিকা একাদশী মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
অভিধানগত অর্থানুসারে, “কম” বা “ক” ধাতুগত শব্দ থেকে “কামনা”, “কামিকা” ইত্যাদি বহু শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সাধারণভাবে এই “কম” বা “ক” এর নেতিবাচক অর্থ হল— (১) কম (২) কদাচিৎ (৩) কুৎসিত (৪) কদাকার (৫) কপট (৬) কাম (লোভ) ইত্যাদি প্রায় ১২৫টি শব্দ।
আবার তন্ত্রমতে “ক” এবং “ম” হল বীজমন্ত্র। মতান্তরে জলজ এবং শিব প্রভৃতি।
“কামিকা”-এর মধ্যে রয়েছে কাম্ধাতু এবং এই শব্দের অর্থ হ’ল (১) আকাঙ্ক্ষিত (২) কামনায় ভরপুর (৩) সফলতা বা বিজয়ী নির্দিষ্ট করে ইত্যাদি।
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
► আরও পড়ুন: পান্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প ও পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: অপরা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: শয়ন একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
কামিকা একাদশী ব্রত কেন পালন করবেন?
কামিকা একাদশীর মতো পবিত্র পাপনাশক শ্রেষ্ঠ ব্রত আর জগতে নেই ।
● এই ব্রত পাপনাশক ও মহাপূণ্যফলদায়ী।
● সমস্ত তীর্থভ্রমনের কোটিগুন ফল লাভ হয়।
● সাগর ও অরণ্য সমৃদ্ধ সমগ্র পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়।
● দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল এই ব্রত পালনে সহজেই লাভ হয়।
● যে সব ব্যাক্তিগন ব্রহ্মহত্যা, ভ্রূণহত্যা কিংবা তার থেকেও বেশি পাপপূর্ণ সাগরে নিমজ্জিত থাকে, তাদের কামিকা একাদশী ব্রতের মাধ্যমে সহজেই সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
● পরবর্তী জীবনে নিম্নযোনি (পশু জীবন) প্রাপ্ত হয় না এবং মনুষ্য শরীর সুনিশ্চিতভাবে প্রাপ্ত হয়।
● তুলসীপত্রে শ্রীহরির পূজায় কৃষ্ণভক্তি লাভ হয়।
● রাত্রি জাগরণ করে যিনি এই ব্রত পালন করেন, তিনি কখনও দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত হন না।
● ব্রত মাহাত্ম্য কেবল শ্রবনেই বাজপেয় যজ্ঞের (একপ্রকার বৈদিক যজ্ঞ) ফললাভ হয়। তাছাড়া যিনি এই ব্রত মাহাত্ম্য শ্রদ্ধা সহকারে পাঠ অথবা শ্রবণ করবেন তিনি সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলােকে গমন করবেন।
কামিকা একাদশী সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৮শে পৌষ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ইং ১৩ই জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার কামিকা একাদশী। ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারনঃ কামিকা একাদশীর পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকাল ০৫:২৫ থেকে ০৯:৫১ মি: মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং সকাল ০৫:০৫ থেকে ০৯:৩০ মি: মধ্যে কলকাতা, ভারত সময়। ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
কামিকা একাদশী সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
কামিকা একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
কামিকা একাদশী মাহাত্ম্য কথা
‘কামিকা’ একাদশী মাহাত্ম্য ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে ‘যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদ’-এ সুন্দরভাবে বর্ণিত রয়েছে।
এই ব্রত সম্পর্কে জানবার জন্য যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে জনার্দন! হে বাসুদেব! শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয় তিথিতে যে একাদশী পালন করা হয় সেই একাদশীর নাম কি এবং এ একাদশীর মাহাত্ম্যই বা কি? কৃপা করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করুন। তা শুনতে আমি অত্যন্ত কৌতুহলী।”
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জানার ইচ্ছার ব্যাকুলতা দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আন্তরিকভাবে অতি প্রসন্ন হলেন এবং প্রত্যুতরে জানালেন – “হে রাজন! এর পূর্বে দেবর্ষি নারদ এই বিষয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে সবিস্তারে জ্ঞাত হয়েছেন। প্রজাপতি ব্রহ্মা যেমন করে বলেছিলেন তেমন করেই আমি পুনরায় বলছি, আপনি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করুন।
একদা ভক্তশ্রেষ্ঠ নারদ ব্রহ্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন – হে ঈশ্বর! শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষ তিথিতে যে একাদশী পালন করা হয় এই একাদশীর নাম কি, এই একাদশী পালনের মাহাত্ম্যই বা কি, এই একাদশীর আরাদ্ধ দেবতা কে, এই একাদশী পালনে কি ফল লাভ হয়? কৃপা করে এই সকল বিষয় সবিস্তারে বর্ণনা করে জ্ঞাত করুন, আমি ধন্য হই।
শ্রীনারদের কথা শুনে ব্রহ্মা অত্যন্ত তৃপ্ত হলেন এবং উত্তরে বললেন – হে বৎস! তুমি যে প্রশ্ন করেছো তার দ্বারা মনুষ্য জাতি অনেক উপকৃত হবে। শুধু তাই নয়, তারা নিম্নযোনি প্রাপ্তি থেকে উদ্ধার হবে ও পাপ থেকে মুক্ত হবে। আর সেই উদ্দেশ্যে আমি সবিস্তারে তোমায় বর্ণনা করছি, তুমি মনস্থির করে তা শ্রবণ করো।
শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ‘কামিকা’ নামে জগতে প্রসিদ্ধ। ভগবান শ্রীবিষ্ণু এই একাদশীর আরাধ্য দেবতা। এই একাদশী পালনে সকল পাপমোচন হয়ে যায়। তাছাড়া এই একাদশীর মাহাত্ম্য শ্রবণ করলে বাজপেয় যজ্ঞের ফল লাভ প্রাপ্ত হয়। গঙ্গা, গোদাবরী, কাশী, নৈমিষ্যারণ্য, পুষ্কর ইত্যাদি তীর্থ দর্শনের সমস্ত ফল কামিকা একাদশীর মাধ্যমে কোটিগুণ লাভ করা যায়। সাগর ও অরণ্য সমৃদ্ধ সমগ্র পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়। দুগ্ধবতী গাভী দানের ফল এই ব্রত পালনে সহজেই লাভ হয়।
যে সব ব্যাক্তিগন ব্রহ্মহত্যা, ভ্রূণহত্যা কিংবা তার থেকেও বেশি পাপপূর্ণ সাগরে নিমজ্জিত থাকে, তাদের কামিকা একাদশী ব্রতের মাধ্যমে সহজেই সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়।
যে সকল ব্যাক্তিরা রাত্রি জাগরণের মাধ্যমে এই ব্রত পালন করেন তাদের কখনও দুঃখ-দুর্দশা থাকে না। পরবর্তী জীবনে নিম্নযোনি (পশু জীবন) প্রাপ্ত হয় না এবং মনুষ্য শরীর সুনিশ্চিতভাবে প্রাপ্ত হয়।
যে ব্যাক্তি তুলসীপত্র দিয়ে বিষ্ণুপূজা করেন তাতে ভগবান এতই প্রসন্ন ও তৃপ্ত হন, মণিমুক্তাদি মূল্যবান রত্ন নিবেদন করলে তেমন প্রীত হন না। যিনি বিষ্ণুর চরণে তুলসীমঞ্জরী (দুটো তুলসীপাতা সমেত তুলসীমঞ্জরী চয়ন করবেন) লালচন্দনে লাগিয়ে নিবেদন করেন তার জন্মার্জিত সমস্ত পাপ ক্ষয় হয়ে যায়।
তুলসী প্রসঙ্গে ব্রহ্মা আরো বললেন – হে নারদ! যে ব্যক্তি প্রতি দিন তুলসী পত্র দর্শন করে থাকেন তার সকল পাপ ভস্মীভূত হয়ে যায়। যে ব্যাক্তি তুলসী পত্র স্পর্শ করেন তার পাপিষ্ঠ দেহ পবিত্র হয়ে যায়। তুলসী গাছে প্রনাম করলে দেহের সকল রোগ দূরীভূত হয়। তুলসী গাছে জল সিঞ্চন করলে যমরাজও তার কাছে আসতে ভয় পায়। শ্রীহরিচরণে তুলসী অর্পণ করলে ভগবদ্ভক্তি লাভ হয়।
যে ব্যাক্তি হরিবাসরে (হিন্দুমতে একাদশীর দিন) ভগবানের সামনে প্রদীপ জ্বালান তার পূণ্যের হিসাব চিত্রগুপ্তও রাখতে পারেন না। এই পূণ্য লাভে তার পূর্বপুরুষেরাও পাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বর্গবাসী হয়ে থাকেন।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
You must be logged in to post a comment.