এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি পাপমোচনী একাদশী মাহাত্ম্য (Papmochani Ekadashi), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি পাপমোচনী একাদশী ব্রত (Papmochani Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
পাপমোচনী একাদশী ব্রত (Papmochani Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কী?
১) যে ব্যাক্তি নিষ্ঠাসহকারে পাপমোচনী একাদশী ব্রত পালন করেন তাদের পূর্বকৃত সমস্ত পাপ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।
২) যে ব্যাক্তি এই ব্রতকথা পাঠ ও শ্রবণ করেন তিনি সহস্র গোদানের ফল লাভ করেন।
পাপমোচনী একাদশী সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৮ মার্চ ২০২৩ শনিবার পাপমোচনী একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০৩ চৈত্র ১৪২৯।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : পাপমোচনী একাদশীর পরদিন অর্থাৎ রবিবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৬:০৪ থেকে ০৮:৪০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৫:৪৪ থেকে ০৮:১০ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
পাপমোচনী একাদশী সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
পাপমোচনী একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
পাপমোচনী একাদশী মাহাত্ম্য কথা
যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন― “হে অচ্যুত! হে ভক্তবতসর! চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম কি, এই একাদশীর মাহাত্ম্যই বা কি কৃপা করে আমায় বলুন। আমি তা জানতে অতি উৎসাহী।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্যময় মুখে তৃপ্ত হাসি, বললেন― “হে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির! আপনি ধর্মবিষয়ক প্রশ্ন করেছেন। এই একাদশী সকল সুখের আধার, সিদ্ধি প্রদানকারী ও পরম মঙ্গলময়। সমস্ত পাপ থেকে নিস্তার বা মোচন করে বলে এই পবিত্র একাদশী তিথি ‘পাপমোচনী’ নামে জগত প্রসিদ্ধ। রাজা মান্ধাতা একবার লোমশ মুনিকে এই একাদশীর কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর বর্ণিত সেই বিচিত্র উপাখ্যানটি আপনার কাছে বলছি। আপনি মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করুন।”
প্রাচীনকালে স্নিগ্ধ অতি মনোরম ‘চৈত্ররথ’ পুষ্প উদ্যানে মুনিগণ বহু বছর ধরে তপস্যা করতেন। একসময় মেধাবী নামে এক ঋষিকুমার সেখানে তপস্যা করছিলেন। মঞ্জ ুঘোষা নামে এক সুন্দরী অপ্সরা তার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তাই সে মেধাবীকে বশীভূত করতে চাইল। কিন্তু ঋষির অভিশাপের ভয়ে সে আশ্রম থেকে দুই মাইল দূরে বাস করে লাগল। বীণা বাজিয়ে মধুর স্বরে সে গান করে মেধাবীকে আকর্ষিত করতে চাইত।
একদিন মেধাবী ঋষি গানের উৎস খুঁজতে খুঁজতে মঞ্জ ুঘোষার কাছে পৌঁছায়। অপ্সরা মেধাবীকে দেখামাত্র কামবাণে পীড়িতা হয়ে পড়ে। এদিকে ঋষি মেধাবীও অপ্সরার অনুপম সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তখন সেই অপ্সরা মুনিকে নানা ছলা-কলা মোহ দ্বারা বশীভূত করে। ক্রমে কামপরবশ হয়ে মুনি সাধন-ভজন বিসর্জন দিয়ে তার আরাধ্য দেব ও তার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যান। এইভাবে অপ্সরার সাথে কামক্রীড়ায় মুনির বহু বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল।
মেধাবী ঋষিকে আচার-ভ্রষ্ট দেখে সেই অপ্সরা দেবলোকে ফিরে যেতে মনস্থির করল। একদিন সুযোগ বুঝে মঞ্জ ুঘোষা মেধাবী মুনিকে অনুরোধ করল― ‘হে প্রভু! অনেক দিন অতিবাহিত হয়েছে এখন আমি নিজ গৃহে ফিরতে ইচ্ছুক। আপনি আমাকে নিজ গৃহে ফিরে যাবার অনুমতি প্রদান করুন।’
কিন্তু মেধাবী ঋষি তখনও অপ্সরার মোহে মোহাচ্ছন্ন। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন― ‘হে সুন্দরী! এখন ত সবে সন্ধ্যাকাল! এই মাত্র তুমি আমার কাছে এসেছ, প্রাতঃকাল পর্যন্ত আমার কাছে থেকে যাও।’
অভিশাপ ভয়ে মুনির কথা শোনা ছাড়া অপ্সরার আর কোনও উপায় রইল না। আরও কয়েক বছর সে ঋষির সাথে বাস করল। এইভাবে বহু বছর (৫৫ বছর ৯ মাস ৭ দিন) অতিবাহিত হল। দীর্ঘকাল অপ্সরার সান্নিধ্যে থাকলেও মেধাবীর কাছে তা অর্ধরাত্রি বলে মনে হল।
এরপর একদিন মঞ্জ ুঘোষা পুনরায় নিজ গৃহে ফিরে যেতে চেয়ে প্রার্থনা জানালে ঋষি জানান― ‘হে সুন্দরী! এখন সবে প্রাতঃকাল, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি সন্ধ্যাবন্দনা না সমাপ্ত করি, ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি এখানে থাক।’
মেধাবী ঋষির এই কথা শুনে ঈষৎ হেসে মঞ্জ ুঘোষা অবগত করালেন― ‘হে মুনিবর! আমার সহবাসে আপনার যে কত বৎসর অতিবাহিত হয়েছে, তা একবার বিবেচনা করে দেখুন।’ এই কথা শুনে মেধাবী স্থির হয়ে দিব্যচিন্তা করে দেখলেন যে, তার জীবনের ছাপ্পান্ন বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং সে আরাধ্য দেবকে এই সময়কালে ভুলে গেছে। সে পথভ্রষ্ট হয়েছে কেবল এই নারীর জন্য।
মোহমুক্ত হয়ে মেধাবী তখন মঞ্জ ুঘোষার প্রতি ক্রোধ পরবশ হয়ে অভিশাপ দিলেন― ‘ওরে পাপিষ্ঠা, দুরাচারিণী, তপস্যার ক্ষয়কারিনী, তোমাকে ধিক্! তোমার সৌন্দর্য নষ্ট হোক, তুমি পিশাচী হও।’ মেধাবীর অভিশাপে অপ্সরার শরীর বিকারগ্রস্ত হল। তখন সে ঋষির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে অবনতমস্তকে শাপমোচনের উপায় জিজ্ঞাসা করল।
ঋষি মেধাবীর মন বিগলিত হল এবং শাপমুক্তির উপায় বলে দিলেন ―’হে সুন্দরী! চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া পাপমোচনী একাদশী, সর্বপাপ ক্ষয়কারিণী। সেই ব্রত পালনে তোমার পিশাচত্ব দূর হবে।’
পিতার আশ্রমে ফিরে অনুতপ্ত মেধাবী আকুতি জানালেন ―’হে পিতা! এক অপ্সরার সঙ্গদোষে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে মহাপাপ করেছি, এর প্রায়শ্চিত্তের উপায় কি? তা কৃপা করে আমায় বলুন।’
উত্তরে চ্যবন মুনি অভয় দিয়ে বললেন ― ‘চৈত্র মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া পাপমোচনী একাদশী ব্রতের প্রভাবে তোমার সমস্ত পাপ দূরীভূত হবে।’ পিতার উপদেশ মতো মেধাবী ঋষি সেই ব্রত পরম ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে পালন করল। ব্রতের পুণ্যফলে তার সমস্ত পাপ ভস্মীভূত হল এবং তিনি পুনরায় তপস্যার ফল লাভ করল। মঞ্জ ুঘোষাও ঐ ব্রত পালনের সুকৃতির ফলে পিশাচত্ব থেকে মুক্ত হয়ে দিব্য দেহে স্বর্গে গমন করল।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির মহারাজের মাধ্যমে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন― ‘হে রাজন! এই পাপমোচনী একাদশী যে ব্যাক্তি নিষ্ঠাসহকারে পালন করেন তাদের পূর্বকৃত সমস্ত পাপ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। তাছাড়াও এই ব্রতকথা পাঠ ও শ্রবণে সহস্র গোদানের ফল লাভ হয়।’ “
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.