এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি পুত্রদা একাদশী মাহাত্ম্য (Putrada Ekadashi Importance), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি পুত্রদা একাদশী ব্রত (Putrada Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
পুত্রদা একাদশী ব্রত (Putrada Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
❏ নিষ্ঠাসহকারে যারা এই পুত্রদা একাদশী ব্রত (Putrada Ekadashi Vrat) পালন করবে, তারা ‘পুত’ নামক নরক থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। আর এই ব্রত কথা শ্রবণ–কীর্তনে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে এই মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।।
❏ পুত্রদা একাদশীর উপবাস নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য শ্রেষ্ঠ একাদশী এবং এই ব্রত পালনের ফলে যোগ্য সন্তান লাভ হয়। তাছাড়া যারা সন্তানদের সুস্থতার জন্য এই ব্রত রাখেন, তাদের সন্তান দীর্ঘায়ু লাভ করে, জীবনে অনেক উন্নতি লাভ করে এবং পরিবারের জন্য খ্যাতি এনে দেয়।
পুত্রদা একাদশী (Putrada Ekadashi) – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০২ জানুয়ারি ২০২৩ সোমবার পুত্রদা একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৭ পৌষ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : পুত্রদা একাদশীর পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৬:৪১ থেকে ১০:১৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৬:১৯ থেকে ০৯:৫৫ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
পুত্রদা একাদশী (Putrada Ekadashi) – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
পুত্রদা একাদশী (Putrada Ekadashi) – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে
আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
পুত্রদা একাদশী মাহাত্ম্য কথা
‘পুত্রদা’ একাদশী মাহাত্ম্য ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে বর্ণিত আছে।
যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “হে জগন্নাথ! পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি? বিধিই বা কি, কোন দেবতা ঐ দিনে পূজিত হন এবং আপনি কার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে সেই ব্রতফল প্রদান করেছিলেন কৃপা করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করুন।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন হৃদয়ে বললেন, “হে মহারাজ! এই একাদশী ‘পুত্রদা’ নামে প্রসিদ্ধ। সর্বপাপবিনাশিনী ও কামদা এই একাদশীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হলেন সিদ্ধিদাতা নারায়ণ! ত্রিলোকে এর মত শ্রেষ্ঠ ব্রত নেই! এই ব্রতকারীকে নারায়ণ বিদ্বান ও যশস্বী করে তোলেন। এখন আমার কাছে পুত্রদা একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য শ্রবণ কর।
ভদ্রাবতী রাজ্যে সুকেতুমান নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর রানীর নাম ছিল শৈব্যা। রাজদম্পতি বেশ সুখেই দিনযাপন করছিলেন।বংশরক্ষার জন্য বহুদিন ধরে ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করেও যখন পুত্রলাভ হল না, তখন রাজা দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়লেন।
বিপুল সম্পত্তি ও সকল ঐশ্বর্য্যের অধিকারী হয়েও পুত্রহীন রাজা ও রানীর মনে কোন সুখ ছিল না। রাজার মাথায় একটা কথায় পাক খেতে থাকে, পুত্রহীন পিতার জন্ম বৃথা ও তার গৃহশূন্য! পিতৃ–দেব–মনুষ্যলোকের কাছে যে ঋণ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, তা পুত্র বিনা পরিশোধ করা সম্ভব নয়! পুত্রবিনা পিন্ডদান কে করবে? পুত্রবানজনের এ জগতে যশলাভ ও উত্তম গতি লাভ হয় এবং তাদের আয়ু, আরোগ্য, সম্পত্তি প্রভৃতি বিদ্যমান থাকে। নানা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে রাজা রাজপথ ঠিকমতো সামলাতে পারছিলেন না, শেষমেশ আত্মহত্যা করবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু পরে বিচার করে দেখলেন – ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, এর ফলে কেবল দেহের বিনাশমাত্র হবে। কিন্তু আমার পুত্রহীনতা তো দূর হবে না।’
তারপর একদিন রাজা রাজপাঠ ছেড়ে নিবিড় বনে গমন করলেন। বন ভ্রমণ করতে করতে দ্বিপ্রহর অতিক্রান্ত হলে রাজা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর হলেন। এদিক ওদিক জলাশয়ের অনুসন্ধান করতে লাগলেন। তিনি চক্রবাক, রাজহংস এবং নানারকম মাছে পরিপূর্ণ একটি মনোরম সরোবর দেখতে পেলেন। সরোবরের কাছে পৌঁছে মুনিদের একটি আশ্রম দেখতে পেয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন। তিনি দেখলেন, সরোবর তীরে মুনিগণ বেদপাঠ করছেন।
মুনিবৃন্দের শ্রীচরণে তিনি দণ্ডবৎ প্রণাম সেরে নিজের পরিচয় দিলেন। মুনিগণ রাজাকে আশ্বস্ত করলেন, “হে মহারাজ! আমরা আপনার প্রতি প্রসন্ন হয়েছি। আপনার কি প্রার্থনা বলুন?”
রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মুনিবর! আপনারা কে এবং কি জন্যই বা এখানে সমবেত হয়েছেন?”
রাজার কৌতূহল জেনে মুনিগণ বললেন, “হে মহারাজ! আমরা ‘বিশ্বদেব’ নামে প্রসিদ্ধ। এই সরোবরে স্নান করতে এসেছি। আজ থেকে পাঁচদিন পরেই মাঘ মাস আরম্ভ হবে। আজ পুত্রদা একাদশী তিথি। পুত্র দান করে বলেই এই একাদশীর নাম ‘পুত্রদা’।”
তাঁদের কথা শুনে রাজার হৃদয়ে আশার সঞ্চার হল এবং উদগ্রীব কণ্ঠে বললেন, “হে মুনিবৃন্দ! আমি অপুত্রক। তাই পুত্র কামনায় অধীর হয়ে পড়েছি। এখন আপনাদের দেখে আমার হৃদয়ে আশার সঞ্চার হয়েছে। এ দুর্ভাগা পুত্রহীনের প্রতি অনুগ্রহ করে একটি পুত্র প্রদান করুন।”
মুনিগণ আশ্বস্ত করে বললেন, “হে মহারাজ! আজ সেই পুত্রদা একাদশী তিথি। তাই এখনই আপনি এই ব্রত পালন করুন। ভগবান শ্রীকেশবের অনুগ্রহে অবশ্যই আপনার পুত্র লাভ হবে।”
মুনিদের কথা শোনার পর যথাবিধানে রাজা কেবল ফলমূলাদি আহার করে সেই ব্রত অনুষ্ঠান করলেন। দ্বাদশী দিনে উপযুক্ত সময়ে শস্যাদি সহযোগে পারণ করলেন।
মুনিদের প্রণাম নিবেদন করে রাজা নিজগৃহে ফিরে এলেন। ব্রতপ্রভাবের ফলে কিছু দিন পর রানী গর্ভধারণ হলেন এবং নয় মাস পর একটি তেজস্বী পুত্র লাভ করলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির মহারাজের উদ্দেশ্যে বললেন, হে মহারাজ! এ ব্রত সকলেরই পালন করা কর্তব্য। মানব কল্যাণ কামনায় আপনার কাছে আমি এই ব্রত কথা বর্ণনা করলাম।
নিষ্ঠাসহকারে যারা এই পুত্রদা একাদশী ব্রত পালন করবে, তারা ‘পুত’ নামক নরক থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে। আর এই ব্রত কথা শ্রবণ–কীর্তনে অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে এই মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।।
পুত্রদা একাদশীর উপবাস নিঃসন্তান দম্পতিদের জন্য শ্রেষ্ঠ একাদশী এবং এই ব্রত পালনের ফলে যোগ্য সন্তান লাভ হয়। তাছাড়া যারা সন্তানদের সুস্থতার জন্য এই ব্রত রাখেন, তাদের সন্তান দীর্ঘায়ু লাভ করে, জীবনে অনেক উন্নতি লাভ করে এবং পরিবারের জন্য খ্যাতি এনে দেয়।”
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.