এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি বরুথিনী একাদশী মাহাত্ম্য (Varuthini Ekadashi Importance), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি বরুথিনী একাদশী ব্রত (Varuthini Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
বরুথিনী একাদশী (Varuthini Ekadashi) – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৬ এপ্রিল ২০২৩ রবিবার বরুথিনী একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০২ বৈশাখ ১৪৩০।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : বরুথিনী একাদশীর পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৫:৩৬ থেকে ০৯:৫০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৫:১৬ থেকে ০৯:৩১ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
বরুথিনী একাদশী ব্রত (Varuthini Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কী?
ব্রতশ্রেষ্ঠ একাদশী শ্রীহরির অত্যন্ত প্রিয়। ভক্তি লাভে ইচ্ছুক সকলেরই কর্তব্য একাদশী ব্রত পালন করা। বরুথিনী একাদশী ব্রত পালনে বহুবিধ ফল লাভ করা যায়।
১) বিধি অনুসারে বরুথিনী একাদশী ব্রত পালনে সর্বপাপক্ষয় হয় এবং সুখ ও সৌভাগ্য প্রাপ্তি ঘটে।
২) দুর্ভাগা স্ত্রীলোক এই ব্রত পালনে সর্বসৌভাগ্য লাভ করে থাকে। ভক্তি ও মুক্তি প্রদানকারী এই ব্রত সর্বপাপহরণ করে এবং গর্ভবাস যন্ত্রনা বিনাশ করে।
৩) অশ্বদান, গজদান, ভূমিদান, তিলদান, স্বর্ণদান, অন্নদান, কন্যাদান, গোদান এই সমস্ত প্রকার দান থেকে বিদ্যাদান শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই বরুথিনী ব্রত পালনে সেই বিদ্যাদানের সমান ফল লাভ হয়ে থাকে।
৪) ১০ হাজার বছরের তপস্যার ফল শুধুমাত্র একটি বরুথিনী একাদশী পালনে লাভ হয়।
৫) বরুথিনী ব্রত পালনকারী ব্যাক্তি কন্যাদান থেকেও বেশি ফল লাভ করে।
৬) যিনি হরিবাসরে (উপবাস চলাকালীন) রাত্রিজাগরণ করে শ্রীবিষ্ণুর পূজা করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে পরমগতি লাভ করেন। তাই সূর্যপুত্র যমরাজের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য পরম যত্নে এই একাদশী ব্রত পালন করা প্রত্যেকের কর্তব্য।
৭) বরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা শ্রদ্ধাসহকারে শুধুমাত্র পাঠ ও শ্রবনে সহস্র গোদানের ফল প্রাপ্ত হয় এবং সহজেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করে।
বরুথিনী একাদশী (Varuthini Ekadashi) – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
বরুথিনী একাদশী (Varuthini Ekadashi) – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে
আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
বরুথিনী একাদশী মাহাত্ম্য কথা
‘বরুথিনী একাদশী‘ মাহাত্ম্য ভবিষ্যোত্তর পুরাণে ‘যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদ’-এ সুন্দরভাবে বর্ণিত রয়েছে।
এই ব্রত সম্পর্কে জানবার জন্য যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে জগন্নাথ! হে বাসুদেব! বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষে যে একাদশী পালন করা হয় সেই একাদশীর নাম কি এবং এ একাদশীর মাহাত্ম্যই বা কি? কৃপা করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করুন। তা শুনতে আমি অত্যন্ত আগ্রহী।”
মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জানার ইচ্ছার ব্যাকুলতা দেখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আন্তরিকভাবে অতি প্রসন্ন হলেন এবং প্রত্যুতরে জানালেন – “হে রাজন! ইহলোক ও পরলোকে বৈশাখ মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ‘বরুথিনী’ নামে খ্যাত। এই ব্রত পালনের ফলে সর্বদা সুখ লাভ হয়, সেইসঙ্গে পাপক্ষয় ও সৌভাগ্য প্রাপ্তি ঘটে।
যদি কোনো দুর্ভাগা নারী এই ব্রত পালন করে তবে সে সর্বসৌভাগ্য লাভ করে থাকে। জানবে, ভক্তি ও মুক্তি প্রদানকারী এই ব্রত সর্বপাপহরণ করে এবং গর্ভবাসকালীন যন্ত্রণা বিনাশ করে। এই ব্রতের সুপ্রভাবে মান্ধাতা, ধুন্ধুমারের মতো আদি রাজারা দিব্যধাম লাভ করেছেন। এমনকি মহাদেব শিবও এই ব্রত পালন করেছিলেন।
১০ হাজার বছরের তপস্যার ফল শুধুমাত্র একটি বরুথিনী একাদশী পালনে লাভ হয়। যে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তি, ভক্তি ও নিষ্ঠা ভরে এই ব্রত পালন করেন তিনি ইহলোক ও পরলোকে সমস্ত ধরনের আকাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করেন।
হে নৃপশ্রেষ্ঠ! অশ্বদান অপেক্ষা গজদান শ্রেষ্ঠ, গজদান থেকে ভূমিদান, ভূমিদান থেকে তিলদান, তিলদান থেকে স্বর্ণদান এবং স্বর্ণদান অপেক্ষা অন্নদান শ্রেষ্ঠ। অন্নদানের মত শ্রেষ্ঠদান আর নেই। পিতৃলোক, দেবলোক ও মানুষেরা অন্নদানেই পরিতৃপ্ত হন। পন্ডিতেরা কন্যাদানকে অন্নদানের সমান বলে থাকেন। স্বয়ং ভগবান গোদানকে অন্নদানের সমান বলেছেন। আবার এই সমস্ত প্রকার দান থেকেও বিদ্যাদান শ্রেষ্ঠ। কিন্তু এই বরুথিনী ব্রত পালনে সেই বিদ্যাদানের সমান ফল লাভ হয়ে থাকে।
পাপচিন্তাসম্পন্ন যে সকল ব্যাক্তি কন্যার উপার্জিত অর্থে জীবনধারণ করে, পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে তাদের আবার নরকযন্ত্রনা ভোগ করতে হয়। তাই কখনও কন্যার উপার্জিত অর্থ গ্রহণ করা উচিত নয়। যে ব্যক্তি বিভিন্ন স্বর্ণালঙ্কার সহ কন্যাদান করেন তাঁর পুণ্যের হিসাব স্বয়ং চিত্রগুপ্তও করতে পারেন না। কিন্তু বরুথিনী ব্রত পালনকারী ব্যাক্তি কন্যাদান থেকেও বেশি ফল লাভ করে।
বরুথিনী ব্রত পালনকারী ব্যাক্তি দশমীর দিনে কাঁসার পাত্রে ভোজন, মাংস, মসুর, ছোলা, শাক, মধু, অন্যের প্রদত্ত অন্নগ্রহণ, দুইবার আহার ও মৈথুন পরিত্যাগ করবে। দ্যূতক্রীড়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য, দিবানিদ্রা, পরনিন্দা-পরচর্চা, প্রতারণা, চুরি, হিংসা, মৈথুন, ক্রোধ ও মিথ্যাবাক্য একাদশীর দিনে বর্জনীয়। কাঁসার পাত্রে ভোজন, মাংস, মসুর, মধু, তেল, মিথ্যাভাষণ, ব্যায়াম, দুইবার আহার ও মৈথুন এসব দ্বাদশীর দিনে পরিত্যাজ্য।
হে রাজন! এই বিধি অনুসারে বরুথিনী ব্রত পালনে সকল প্রকার পাপের বিনাশ এবং অক্ষয় গতি লাভ হয়। যিনি হরিবাসরে (উপবাস চলাকালীন) রাত্রিজাগরণ করে শ্রীবিষ্ণুর পূজা করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হয়ে পরমগতি লাভ করেন। তাই সূর্যপুত্র যমরাজের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য পরম যত্নে এই একাদশী ব্রত পালন করা প্রত্যেকের কর্তব্য।
বরুথিনী একাদশীর ব্রতকথা শ্রদ্ধাসহকারে শুধুমাত্র পাঠ ও শ্রবনে সহস্র গোদানের ফল প্রাপ্ত হয় এবং সহজেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করে।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.