এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি বিজয়া একাদশী মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র। তাই যথাবিধি যে মানুষ এই ব্রত পালন করবে, তাদের এ জগতে জয়লাভ ও পরজগতে অক্ষয় সুখ সুনিশ্চিত জানবে।
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
► আরও পড়ুন: পান্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প ও পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: অপরা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: শয়ন একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র
বিজয়া একাদশী সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪ই ফালগুন ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, ইং ২৭শে ফেবরুয়ারি ২০২২ রবিবার বিজয়া একাদশী। ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারনঃ বিজয়া একাদশীর পরের দিন অর্থাৎ সোমবার সকাল ০৬:২১ থেকে ১০:১৪ মি: মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং সকাল ০৬:০১ থেকে ০৯:৫৪ মি: মধ্যে কলকাতা, ভারত সময়। ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
বিজয়া একাদশী সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
বিজয়া একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
বিজয়া একাদশী মাহাত্ম্য কথা
‘বিজয়া’ একাদশী মাহাত্ম্য স্কন্দপুরাণে বর্ণিত আছে।
যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “হে বাসুদেব! ফালগুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর মাহাত্ম্য অনুগ্রহ করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করুন।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে কৌন্তেয়, এই একাদশী `বিজয়া’ নামে পরিচিত। এই একাদশী ব্রত কথা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে প্রথম দেবর্ষি নারদ স্বয়ম্ভু ব্রহ্মার থেকে জ্ঞানলাভ করেছিলেন। তিনি এই প্রসঙ্গে যা বলেছিলেন, তা আমি তোমাকে বলছি। এই পবিত্র পাপবিনাশকারী ব্রত মানুষকে জয় দান করে বলে এই একাদশীর নাম বিজয়া।
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র ১৪ বছরের জন্য বনে গিয়েছিলেন। সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে তিনি পঞ্চবটী বনে বাস করতেন। সেইসময় লঙ্কাপতি রাবণ সীতা দেবীকে হরণ করেন। সীতার অনুসন্ধানে রামচন্দ্র চতুর্দিক ভ্রমণ করতে থাকেন। তখন মৃতপ্রায় জটায়ুর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। জটায়ু অন্তিমকালে রাবণের সীতাহরণের সমস্ত ঘটনা রামচন্দ্রকে জানিয়ে মৃত্যুবরণ করল। এর পর সীতামাতাকে উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে বানররাজ সুগ্রীবকে বালির হাত থেকে রক্ষা করে তাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দেন, ফলে সুগ্রীবরাজ প্রভু রামের দাসত্ব স্বীকার করে বিশাল সেনাসহ লঙ্কার দিকে অগ্রসর হয়।
ভগবান রামচন্দ্রের কৃপায় হনুমান এক লাফে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় উপস্থিত হয়। সেখানে বন্দি যমরাজকে মুক্ত করেন। অত্যাচারে জর্জরিত উল্টো করে ঝোলানো শনিদেবকে উদ্ধার করেন। তাছাড়া বন্দী ইন্দ্রদেব, বরুণদেবের মতো সমস্ত দেবতাদের করুণ অবস্থা দেখে ব্যাথিত হন। এরপর অশোক বনে সীতাদেবীকে দর্শন করে শ্রীরামচন্দ্র প্রদত্ত আংটি তাঁকে অর্পণ করেন। সীতামাতা হনুমানের সাথে ফিরতে অস্বীকার করেন কারন, তিনি তাঁর স্বামী রামচন্দ্রের সাথে ফিরতে চান। ফিরে আসার আগে লঙ্কাকাণ্ড (অর্থাৎ লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া) ঘটিয়ে রাবনের দর্প চূর্ণ করে দেন।
ফিরে এসে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে লঙ্কার সমস্ত ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। হনুমানের কথা শুনে রামচন্দ্র সুগ্রীবের পরামর্শে সমুদ্রতীরে যান। সেই দুস্তর সমুদ্র দেখে তিনি লক্ষ্মণকে বললেন, হে লক্ষ্মণ, কিভাবে এই অগাধ সমুদ্র পার হওয়া যায়, তার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা।
উত্তরে লক্ষ্মণ বললেন, হে পুরুষোত্তম, সর্বজ্ঞাতা আদিদেব আপনি, আপনাকে আমি কি উপদেশ করব? তবে বক্দালভ্য নামে এক মুনি এই দ্বীপে বাস করেন এবং এখান থেকে চার মাইল দূরে তাঁর আশ্রম। হে রঘুপতি রাঘব, আপনি সেই প্রাচীন ঋষিশ্রেষ্ঠকে এর উপায় জিজ্ঞাসা করুন, তিনি নিশ্চয় এর উপায় বলে দেবেন।
লক্ষ্মণের মনোরম কথা শুনে তারা সেই মহামুনি বক্দালভ্যের আশ্রমে উপনীত হলেন এবং ভগবান রামচন্দ্র সেই মুনিকে ভক্তি সহকারে প্রণাম করলেন। মুনিবর শ্রীরামচন্দ্রকে পুরাণ পুরুষ রূপে চিনতে পারলেন এবং তিনি সশরীরে আশ্রমে উপস্থিত ভেবেই আনন্দে ভরে উঠল মহামুনির হৃদয়। তিনি বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, হে প্রভু রামচন্দ্র, কি কারনে আপনি আমার শরণাপন্ন হয়েছেন কৃপা করে আমাকে বলুন। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?
শ্রীরামচন্দ্র বললেন, হে মুনিবর, আপনার কৃপায় সৈন্যসহ আমি এই সমুদ্রতীরে উপস্থিত হয়েছি। রাক্ষসরাজের লঙ্কাবিজয় করে আমার পত্নি সীতাকে উদ্ধার করাই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। যাতে এই ভয়ঙ্কর সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে পারি, তার উপায় জানবার জন্য আমরা আপনার কৃপা প্রার্থনা করি।
মুনিবর প্রসন্ন চিত্তে পদ্মলোচন ভগবান রামচন্দ্রকে বললেন, হে প্রভু রামচন্দ্র, আপনার অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য যে শ্রেষ্ঠ ব্রত করণীয়, তা বলছি মন দিয়ে শ্রবণ করুন। ফালগুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের বিজয়া নামক একাদশী পালনের সুফল প্রাপ্তি হিসাবে আপনি নিশ্চয়ই সৈন্যসহ সমুদ্র পার হতে পারবেন। বিজয় লাভের জন্য দশমীর দিন সোনা, রূপা, তামা অথবা মাটির কলস সংগ্রহ করে তাতে জল ও আমপাতা দিয়ে সুগন্ধিচন্দনে সাজিয়ে তার উপর সোনার নারায়ণ মূর্তি স্থাপন করবেন। একাদশীর দিন যথাবিধি প্রাতঃস্নান করে কলসের গলায় মালাচন্দন পরিয়ে উপযুক্ত স্থানে নারকেল ও গুবাক (=সুপারি) দিয়ে পূজা করবেন। এরপর গন্ধ,পুষ্প, তুলসী, ধূপ-দীপ নৈবেদ্য ইত্যাদি দিয়ে পরম ভক্তি সহকারে নারায়ণের পূজা করে হরিকথা কীর্তনে সমস্ত দিন যাপন করবেন। রাত্রি জাগরণ করে অখন্ড ঘি দিয়ে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রাখবেন। দ্বাদশীর দিন সূর্যোদয়ের পর সেই কলস বিসর্জনের জন্য কোন নদী, সরোবর বা জলাশয়ের কাছে বিধি অনুসারে পূজা নিবেদনের পর তা বিসর্জন দেবেন। তারপর ঐ মূর্তি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মনকে দান করবেন। এই ব্রত প্রভাবে নিশ্চয় আপনার বিজয় লাভ হবে।
প্রজাপতি ব্রহ্মা বললেন, হে নারদ, ঋষির কথামত ব্রত অনুষ্ঠানের ফলে শ্রীরামচন্দ্র বিজয়ী হয়েছিলেন। সীতাপ্রাপ্তি, লঙ্কাজয়, রাবণবধের মাধ্যমে তিনি অতুল কীর্তি লাভ করেছিলেন। তাই যথাবিধি যে মানুষ এই ব্রত পালন করবে, তাদের এ জগতে জয়লাভ ও পরজগতে অক্ষয় সুখ সুনিশ্চিত জানবে। হে যুধিষ্ঠির, এই কারনে এই ব্রত পালন অবশ্য কর্তব্য। “
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
You must be logged in to post a comment.