এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি যোগিনী একাদশী মাহাত্ম্য (Yogini Ekadashi Importance), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেইসঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি যোগিনী একাদশী ব্রত (Yogini Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
যোগিনী একাদশী ব্রত (Yogini Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কী?
১) মহাপাপ বিনাশকারী এই তিথি পাপসাগরে পতিত মানুষের উদ্ধারলাভের একমাত্র নৌকাস্বরূপ। ব্রত পালনকারীদের পক্ষে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত নামে প্রসিদ্ধ।
২) যোগিনী একাদশী ব্রত পালনে অষ্টাশি হাজার (৮৮,০০০) ব্রাহ্মণকে ভোজন করানোর ফল লাভ হয়।
৩) যে ব্যক্তি এই মহাপাপ বিনাশকারী ও পুণ্য ফল প্রদায়ী যোগিনী একাদশীর কথা পাঠ ও শ্রবণ করে সে অচিরেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়।
যোগিনী একাদশী (Yogini Ekadashi) – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৪ জুন ২০২৩ বুধবার যোগিনী একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : যোগিনী একাদশীর পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৫:১১ থেকে ০৯:০৪ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৪:৫২ থেকে ০৮:৩৪ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
যোগিনী একাদশী (Yogini Ekadashi) – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
যোগিনী একাদশী (Yogini Ekadashi) – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন?
সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য কথা
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে বর্ণিত আছে।
মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “হে বাসুদেব! আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য কি কৃপাবশত আমার কাছে বর্ণনা করুন।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্মিত হেসে এই একাদশীর মাহাত্ম্য বলতে শুরু করলেন, “হে মহারাজ! সকল পাপবিনাশিনী ও মুক্তিপ্রদ এই উত্তম ব্রতের কথা বলছি, আপনি শ্রবণ করুন। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশী ‘যোগিনী’ নামে পরিচিত। মহাপাপ বিনাশকারী এই তিথি পাপসাগরে পতিত মানুষের উদ্ধারলাভের একমাত্র নৌকাস্বরূপ। ব্রত পালনকারীদের পক্ষে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত নামে প্রসিদ্ধ। এই প্রসঙ্গে আপনাকে একটি পবিত্র পৌরাণিক কাহিনী শোনায়।
একসময় অলকা নগরে শিবভক্ত পরায়ণ কুবের নামে এক রাজা ছিল। তিনি প্রত্যহ শিবপূজা করতেন। তার হেমমালী নামে একজন মালী ছিল এবং সে প্রতিদিন শিব পূজার জন্য মানস সরোবর থেকে ফুল তুলে যক্ষরাজ কুবেরকে দিত। বিশালাক্ষী নামে হেমমালীর এক পরমা রূপবতী পত্নী ছিল। সে তার সুন্দরী পত্নীর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিল। একদিন সে তার স্ত্রীর প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়ল। রাজভবনে যাওয়ার কথাও সে ভুলে গেল। বেলা দুই প্রহর কেটে গেল। অর্চনের সময় চলে যাচ্ছে কিন্তু ফুল এসে পৌঁছাল না, সব দেখে রাজা অস্থির ও বিচলিত হলেন। মালীর বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান করতে এক রাজদূত প্রেরণ করলেন তার বাড়িতে।
রাজদূত সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে এসে রাজাকে জানালেন, ‘হেমমালী গৃহে স্ত্রীর সাথে আনন্দে মত্ত।’
দূতের কথা শুনে কুবের রেগে তখনই মালীকে তার সামনে হাজির করতে আদেশ দিল। এদিকে মালী পূজার সময় অতিবাহিত হয়েছে বুঝতে পেরে অত্যন্ত ভয় পেল। তাই স্নান না করেই সে রাজার কাছে উপস্থিত হল।
তাকে দেখামাত্র রাজা ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে চোখ রাঙিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে দিলেন ধমক, ‘ওরে পাপিষ্ঠ, দুরাচার! তুই দেবপূজার পুষ্প আনতে অবজ্ঞা করিস! রাজকাজে অবহেলা করিস! তাই আমি তোকে অভিশাপ দিচ্ছি তুই শ্বেতকুষ্ঠগ্রস্ত হয়ে যা এবং তোর প্রিয়তমা ভার্যার সাথে তোর চিরবিয়োগ সংগঠিত হোক। ওরে নীচ! তুই এখনি এই স্থান থেকে ভ্রষ্ট হয়ে অধোগতি লাভ কর।’
কুবেরের এই অভিশাপে হেমমালী তার পত্নীর সাথে স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ কুষ্ঠরোগ ভোগ করতে লাগল। রোগের তীব্র যন্ত্রণায় সে নরকযন্ত্রণা দিনের পর দিন ভোগ করতে লাগল, দিন কিংবা রাত কখনই সে সুখ পেত না। এভাবে শীত গ্রীষ্মে প্রচন্ড বেদনায় বহু কষ্টে সে জীবন যাপন করতে লাগল। কিন্তু দীর্ঘদিন মহাদেবের অর্চনের ফুল সংগ্রহের সুকৃতির ফলে সে শাপগ্রস্ত হয়েও বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ শিবের বিস্মরণ কখনও হয়নি।
একদিন হেমমালী ভ্রমণ করতে করতে হিমালয়ে শ্রী মার্কণ্ডেয় ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হল। কুষ্ঠরোগে পীড়িত সপত্নী হেমমালীকে দর্শন করে শ্রী মার্কণ্ডেয় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কার অভিশাপে এই রকম নিন্দনীয় কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হয়েছ?’
সে কাতর কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘হে মুনিবর! রাজা ধনকুবেরের আমি ভৃত্য ছিলাম। আমার নাম হেমমালী। আমি প্রত্যহ মানস সরোবর থেকে ফুল তুলে শিব পূজার জন্য রাজাকে দিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে একদিন স্ত্রীর মনোরঞ্জন হেতু কামাসক্ত হওয়ায় সেই ফুল দিতে বিলম্ব হয়। রাজার অভিশাপে এই রকম দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছি। পরোপকারই সাধুগণের স্বাভাবিক কর্ম। হে ঋষিশ্রেষ্ঠ! আমি অত্যন্ত অপরাধী। কৃপা করে আমার প্রতি প্রসন্ন হন।’
এতে মার্কণ্ডেয় ঋষির মন বিগলিত হল এবং এই রোগজ্বালা ভোগ থেকে মুক্তির পথ বলে দিলেন, ‘হে মালী! তোমার মঙ্গলের জন্য শুভফল প্রদানকারী এক ব্রতের উপদেশ দিচ্ছি। তুমি আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের ‘যোগিনী’ নামক একাদশী পালন কর। এই ব্রতের পুণ্য প্রভাবে তুমি অবশ্যই কুষ্ঠব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, মার্কণ্ডেয় ঋষির উপদেশ শ্রবণ করে হেমমালী তাকে প্রণাম জানিয়ে আশ্রম ত্যাগ করল। পরে অত্যন্ত আনন্দে ঋষির আদেশ মতো নিষ্ঠার সঙ্গে যোগিনী একাদশী ব্রত পালন করল এবং যোগিনী একাদশীর সুফল প্রভাবে হেমমালী সমস্ত রোগ থেকে মুক্ত হয়ে পত্নীসহ সুখে জীবন যাপন করতে লাগল।
হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! আমি আপনার কাছে এই ব্রত উপবাসের মহিমা কীর্তন করলাম। এই ব্রত পালনে অষ্টাশি হাজার (৮৮,০০০) ব্রাহ্মণকে ভোজন করানোর ফল লাভ হয়। যে ব্যক্তি এই মহাপাপ বিনাশকারী ও পুণ্য ফল প্রদায়ী যোগিনী একাদশীর কথা পাঠ ও শ্রবণ করে সে অচিরেই সর্বপাপ থেকে মুক্ত হয়।”
একাদশী ব্রত পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল উপবাস করা নয়, নিরন্তর শ্রীভগবানের স্মরণ, মনন ও শ্রবন কীর্ত্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করতে হয়। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের এই দিন পঁচিশ মালা বা যতেষ্ট সময় পেলে আরও বেশী মহামন্ত্র জপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একাদশী পালনের সময় পরনিন্দা, পরিচর্চা, মিথ্যা ভাষন, ক্রোধ, দুরাচারী, স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.