এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি শয়ন একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
► আরও পড়ুন: পান্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য, সংকল্প ও পারণ মন্ত্র
► আরও পড়ুন: মহাভারতে অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা || ইসকন
► আরও পড়ুন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ১০টি প্রতিজ্ঞা মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে
► আরও পড়ুন: ৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী ||ইসকন
শয়ন একাদশীর সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ শে আষাঢ় ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ,ইং ১০শে জুলাই ২০২২ রবিবার শয়ন একাদশী। ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারনঃ শয়ন একাদশীর পরের দিন অর্থাৎ সোমবার সকাল ০৫:১৮ থেকে ০৯:৪৮ মি: মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং সকাল ০৪:৫৯ থেকে ০৯:২৮ মি: মধ্যে কলকাতা, ভারত সময়। ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
শয়ন একাদশী সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
শয়ন একাদশী পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
শয়ন একাদশীর মাহাত্ম্য কথা
মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “হে জনার্দন! আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কী? এর মহিমাই বা কী? আমাকে কৃপা করে বলুন।” শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “ব্রহ্মা এই একাদশী সম্পর্কে দেবর্ষি নারদকে বলে গিয়েছেন। আমি সেই আশ্চর্যজনক কথা আপনাকে বলছি।”
শ্রীব্রহ্মা বললেন -“হে নারদ! এ সংসারে একাদশীর মতো পবিত্র আর কোন ব্রত নেই। সকল পাপ বিনাশের জন্য এই বিষ্ণুব্রত পালন করা একান্ত আবশ্যক। যে ব্যক্তি এই প্রকার পবিত্র পাপনাশক এবং সকল অভিষ্ট প্রদাতা একাদশী ব্রত না করে তাকে নরকগামী হতে হয়। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের এই একাদশী ‘শয়নী’ নামে বিখ্যাত। শ্রীভগবান হৃষিকেশের জন্য এই ব্রত পালন করতে হয়। এই ব্রতের সম্বন্ধে এক মঙ্গলময় পৌরাণিক কাহিনী আছে।”
“বহু বছর আগে সূর্যবংশে মান্ধাতা নামে একজন রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যপ্রতিজ্ঞ এবং প্রতাপশালী চক্রবর্তী রাজা। প্রজাদের তিনি নিজের সন্তানের মতো পালন করতেন। সেই রাজ্যে কোনও রকম, দুঃখ, রোগ, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব অথবা কোনও অন্যায় ছিল না। এই ভাবে বহু দিন অতিবাহিত হল। কিন্তু এক সময় দৈবদুর্বিপাকে টানা তিন বছর সে রাজ্যে কোনও বৃষ্টি হল না। দুর্ভিক্ষের ফলে সেখানে দেবতাদের উদ্দেশে দানমন্ত্রের ‘স্বাহা’ ‘স্বধা’ ইত্যাদি শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি বেদপাঠও ক্রমশ বন্ধ হল।
তখন প্রজারা রাজার কাছে এসে বলতে লাগলেন- শাস্ত্রে জলকে ‘নার’ বলা হয় আর সেই জলে ভগবানের ‘অয়ন’ অর্থাৎ ‘নিবাস’। তাই ভগবানের এক নাম নারায়ণ। মেঘরূপে ভগবান বিষ্ণু সর্বত্র বারিবর্ষণ করেন। সেই বৃষ্টি থেকে অন্ন এবং অন্ন খেয়ে প্রজাগণ জীবন ধারণ করে। এখন সেই অন্নের অভাবে প্রজারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। অতএব, হে মহারাজ আপনি এমন কোনও উপায় অবলম্বন করুন, যাতে আপনার রাজ্যের শান্তি এবং কল্যাণ সাধন হয়।
রাজা মান্ধাতা বললেন, তোমরা ঠিকই বলেছ। অন্ন থেকে প্রজার উদ্ভব। অন্ন থেকেই প্রজার পালন। তাই অন্নের অভাবে প্রজারা বিনষ্ট হন। আবার রাজার দোষেও রাজ্য নষ্ট হয়। আমি নিজের বুদ্ধিতে আমার কোনও দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও প্রজাদের কল্যাণের জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব।
তারপর রাজা ব্রহ্মাকে প্রণাম করে সৈন্যসহ বনে গমন করে প্রধান প্রধান ঋষিদের আশ্রমে ভ্রমণ করলেন। এভাবে একদিন তিনি ব্রহ্মার পুত্র মহাতেজস্বী অঙ্গিরা ঋষির সাক্ষাৎ লাভ করলেন। তাঁকে দর্শনমাত্রই রাজা মাহানন্দে ঋষির চরণ বন্দনা করলেন। মুনিবর তাঁকে আশীর্বাদ ও কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। রাজা তখন তার বনে আগমনের কারণ সবিস্তারে ঋষির কাছে জানালেন।
ঋষি অঙ্গিরা কিছু সময় ধ্যানস্থ থাকার পর জানতে পারলেন, “হে রাজন! এটি সত্যযুগ। এই যুগে সবাই বেদপরায়ণ এবং ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কেউ তপস্যা করেন না। এই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও একজন শূদ্র রাজ্যে তপস্যা করছে। তার এই অকার্যের জন্যই রাজ্যের এই দুর্দশা। তাকে হত্যা করলেই সকল দোষ দূর হবে।”
রাজা মান্ধাতা বললেন, “হে মুনিবর। তপস্যাকারী নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমি কী ভাবে বধ করব? আমার পক্ষে সহজসাধ্য অন্য কোনও উপায় থাকলে আপনি দয়া করে আমাকে বলুন।”
তদুত্তরে মহর্ষি অঙ্গিরা বললেন, “আপনি আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ‘শয়নী’ নামে প্রসিদ্ধ একাদশী ব্রত পালন করুন। এই ব্রতের প্রভাবে নিশ্চয়ই রাজ্যে বৃষ্টি হবে। এই একাদশী সর্বসিদ্ধি দাত্রী এবং সর্ব উপদ্রব নাশকারিনী। হে রাজন, প্রজা ও পরিবারবর্গ-সহ আপনি এই ব্রত পালন করুন।”
মুনিবরের কথা শুনে রাজা নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন। আষাঢ় মাস উপস্থিত হলে রাজ্যের সকল প্রজা রাজার সঙ্গে এই একাদশী ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন। ব্রতের প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হল। কিছুকালের মধ্যেই অন্নাভাব দূর হল। ভগবান হৃষিকেশের কৃপায় প্রজারা সুখী হলেন।”
এ কারণে সুখ ও মুক্তি প্রাদানকারী এই ব্রত পালন করা সকলেরই অবশ্য কর্তব্য। ভবিষোত্তর পুরাণে যুধিষ্ঠির–শ্রীকৃষ্ণ তথা নারদ-ব্রহ্মা সংবাদ রূপে এই মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!