এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য (Shattila Ekadashi Importance), সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত, সংকল্প মন্ত্র, পারণ মন্ত্র।
সেই সঙ্গে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি ষটতিলা একাদশী ব্রত (Shattila Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
ষটতিলা একাদশী ব্রত (Shattila Ekadashi Vrat) পালনের উদ্দেশ্য কি?
❏ ষটতিলা ব্রতের প্রভাবে দারিদ্রতা, শারীরিক কষ্ট, দুর্ভাগ্য প্রভৃতি বিনষ্ট হয়।
❏ এই ব্রতের বিধি অনুসারে তিলদান করলে মানুষ অনায়াসে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়।
ষটতিলা একাদশীতে তিলের ব্যবহার
ষটতিলা একাদশীতে ছয়টি ভিন্ন উপায়ে তিল ব্যবহার করা হয়, তাই এই একাদশীর নাম ষট (ছয়) ও তিলা (তিল)।
১) তিল মেশানো জলে স্নান – স্নানের জলে তিল মিশিয়ে ‘ওম্ নমোঃ ভগবতে বাসুদেবায়‘ বা ‘হরিমন্ত্র’ জপ করতে করতে স্নান করুন।
২) তিল শরীরে ধারণ – কিছুটা তিল পুঁটলি করে গলায় বা কব্জিতে মাধুলি হিসাবে ধারণ করুন, তিলের তেল শরীরে মাখুন।
৩) তিল দিয়ে যজ্ঞ – গরুর ঘিতে তিল মিশিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে আরতি বা যজ্ঞ করুন।
৪) তিল মিশ্রিত জল পান – সারাদিন তিল মেশানো জল পান করুন এতে অনেক রোগ নিরাময় হয়। তাছাড়া, দক্ষিণ দিকে মুখ করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তিল মিশ্রিত জল তর্পণ করলে পূর্বপুরুষের আশীর্বাদ পাওয়া যায়, তাদের আক্রোশ কমে যা জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসে।
৫) তিল ভোজন – তিলের লাড্ডু, গুড় দিয়ে তিল চিটে, কিংবা খাবারে তিল ব্যবহার করে ভগবানকে ভোগ নিবেদন করুন এবং পরে তা প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করুন।
৬) তিল দান – ষটতিলা একাদশীতে অবশ্যই তিল দান করুন বা ভগবানকে নিবেদনের পর তিলের প্রসাদ দান করুন, এর ফলে তিনি নরকের কষ্ট থেকে রক্ষা পান।
ষটতিলা একাদশী (Shattila Ekadashi) – সময়সূচী ও পারন মুহূর্ত
যারা আমিষ আহার করেন, তারা একাদশীর আগের দিন অর্থাৎ দশমী, একাদশী এবং দ্বাদশী এই তিন দিন নিরামিষ আহার করবেন।
দশমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে ফুল নিবেদন করে সঙ্কল্প করবেন, হে ভগবান! আমাকে কৃপা করুন যাতে আগামীকাল একাদশী যেন নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারি।
❏ ইংরাজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ বুধবার ষটতিলা একাদশী।
❏ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ০৩ মাঘ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
ভোরে স্নান সেরে ভগবানের সম্মুখে সঙ্কল্প মন্ত্র পাঠ করবেন।
পারণ : ষটতিলা একাদশীর পরদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সকালে পারণ সম্পন্ন করতে হবে।
❏ সকাল ০৬:৪২ থেকে ১০:২০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা, বাংলাদেশ সময় এবং
❏ সকাল ০৬:২১ থেকে ১০:০০ মিনিটের মধ্যে কলকাতা, ভারতীয় সময়।
ভোরে স্নান সেরে পারন মন্ত্র পাঠ করে একাদশীর ফল ভগবানের নিকট অবশ্যই অর্পণ করবেন, নচেৎ পূর্ণ একাদশীর ফল লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন।
ষটতিলা একাদশী (Shattila Ekadashi) – সংকল্প মন্ত্র
একাদশীর দিন ভগবান কৃষ্ণের সম্মুখে আমরা অবশ্যই সংকল্প নেব –
একাদশ্যাম্ নিরাহারঃ স্থিতা অহম্ অপরেহহনি।
ভোক্ষ্যামি পুন্ডরীকাক্ষ স্মরনম্ মে ভবাচ্যুত।।
অনুবাদ : হে পুন্ডরীকাক্ষ! হে অচ্যূত! একাদশীর দিন উপবাস থেকে এই ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি।
ষটতিলা একাদশী (Shattila Ekadashi) – পারন মন্ত্র
একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর অর্থাৎ, উপবাসের পরদিন সকালে যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে একাদশীর পারণ মন্ত্র তিনবার ভক্তিভরে পাঠ করতে হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত ভাবে দরকার, নতুবা একাদশীর পূর্ণ ফল লাভ হবে না। আর অবশ্যই একাদশীর আগের দিন ও পরের দিন নিরামিষ প্রসাদ গ্রহণ করতে হবে।
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ —
ওঁ অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব।
প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব॥
—- (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অনুবাদ : হে কেশব! আমি অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে নিমজ্জিত আছি। হে নাথ! এই ব্রত দ্বারা আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমাকে জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন।
এছাড়াও আরও জানুন – একাদশী ব্রত কেন করা উচিত? একাদশীর আবির্ভাব কীভাবে হয়েছিল ? শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী। একাদশীতে কি আহার গ্রহণ করবেন? সব কিছু জানতে
আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
ষটতিলা একাদশী মাহাত্ম্য কথা
‘ষটতিলা’ একাদশীর মাহাত্ম্য ভবিষ্যোত্তরপুরাণে বর্ণিত আছে।
যুধিষ্ঠির মহারাজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, “হে জগন্নাথ! মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথির নাম কি, বিধিই বা কি এবং তার কি ফল, সবিস্তারে বর্ণনা করুন।”
ভগবান মনে মনে খুশি হয়ে প্রত্যুত্তরে বললেন, “হে রাজন! মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী ‘ষটতিলা’ নামে খ্যাত। একসময় দালভ্য ঋষি মুনিশ্রেষ্ঠ পুলস্ত ঋষিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মর্ত্যলোকে মানুষেরা ব্রহ্মহত্যা, গোহত্যা, অন্যের সম্পদ হরণ আদি পাপকর্ম দ্বারা নরকে গমন করে। যাতে তারা নরক গতি থেকে রক্ষা পায়, তা যথাযথভাবে আমাকে উপদেশ করুন। অনায়াসে সাধন করা যায় এমন কোন কাজের মাধ্যমে যদি তাদের এই পাপ থেকে উদ্ধারের কোন উপায় থাকে, তবে তা কৃপা করে বলুন।”
ঋষি পুলস্ত্য প্রসন্ন হয়ে বললেন, “হে মহাভাগ! তুমি যথার্থ একটি গোপনীয় উত্তম বিষয়ে প্রশ্ন করেছ। মাঘ মাসে শুচি, জিতেন্দ্রিয়, কাম, ক্রোধ প্রভৃতি শূন্য হয়ে স্নানের পর সর্বদেবেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজা করবে। পূজাতে কোন বিঘ্ন ঘটলে কৃষ্ণনাম স্মরণ করবে। রাত্রিতে অর্চনান্তে হোম করবে। তারপর চন্দন, অগুরু, কর্পুর ও শর্করা প্রভৃতি দ্বারা নৈবেদ্য প্রস্তুত করে ভগবানকে নিবেদন করবে।
কুষ্মান্ড (=কুমড়ো), নারকেল অথবা একশত গুবাক (=সুপারি) দিয়ে অর্ঘ্য প্রদান করবে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃপালুস্তমগতীনাম্ গতির্ভব’ ইত্যাদি মন্ত্রে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে হয়। ‘কৃষ্ণ আমার প্রতি প্রীত হোন’ বলে যথাশক্তি ব্রাহ্মণকে জলপূর্ণ কলস, ছত্র (=ছাতা), বস্ত্র, পাদুকা (=জুতা), গাভী ও তিলপাত্র দান করবে। স্নান, দানাদি কার্যে কালো তিল অত্যন্ত শুভ।
হে দ্বিজোত্তম! ঐ প্রদত্ত তিল থেকে পুনরায় যে তিল উৎপন্ন হয়, ঠিক ততো বছর দানকারী স্বর্গলোকে বাস করে। তিলদ্বারা স্নান, তিল শরীরে ধারণ, তিল দিয়ে যজ্ঞ, তিল মিশ্রিত জল পান, তিল ভোজন এবং তিল দান– এই ছয় প্রকার বিধানে সর্বপাপ বিনষ্ট হয়ে থাকে। এই জন্য এই একাদশীর নাম ষটতিলা।”
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে যুধিষ্ঠির! একসময় নারদ মুনি এই ষটতিলা একাদশীর ফল ও ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে যে কাহিনী আমি বলেছিলাম তা এখন তোমাকে বর্ণনা করছি।
পুরাকালে মর্ত্যলোকে এক ব্রাহ্মণী বাস করত। সে প্রত্যহ ব্রত আচরণ ও দেবপূজাপরায়ণা ছিল। উপবাস ক্রমে তার শরীর অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল।
সেই মহাসতী ব্রহ্মণী অন্যের কাছ থেকে দ্রব্যাদি গ্রহণ করে দেবতা, ব্রাহ্মণ, কুমারীদের ভক্তিভরে দান করত। কিন্তু কখনও ভিক্ষুককে ভিক্ষাদান ও ব্রাহ্মণকে অন্নদান করেনি। এইভাবে বহু বছর অতিক্রান্ত হল। আমি চিন্তা করলাম, কষ্টসাধ্য বিভিন্ন ব্রত করার ফলে এই ব্রাহ্মণীর শরীরটি শুকিয়ে যাচ্ছে।
সে যথাযথভাবে বৈষ্ণবদের অর্চনও করেছে, কিন্তু তাদের পরিতৃপ্তির জন্য কখনও অন্ন দান করেনি। তাই আমি একদিন কাপালিক রূপ ধারণ করে তামার পাত্র হাতে নিয়ে তার কাছে গিয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করলাম।
ব্রাহ্মণী বলল —হে ব্রাহ্মণ! তুমি কোথা থেকে এসেছ, কোথায় যাবে, তা আমাকে বলো।
আমি বললাম- হে রমণী! আমি একজন ভিক্ষুক, ভিক্ষাই আমার কর্মবৃত্তি, আমাকে ভিক্ষা দাও। তখন সে রাগান্বিত হয়ে আমার পাত্রে একটি মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করল। ব্রাহ্মণীর মনোভাব বুঝতে পেরে স্মিত হেসে আমি সেখান থেকে চলে গেলাম।
বহুকাল পরে সেই ব্রাহ্মণী ব্রতের সুফল পেয়ে স্বশরীরে স্বর্গে যাত্রা করল। মাটির ঢেলা দানের ফলে একটি মনোরম গৃহ তার প্রাপ্ত হল। কিন্তু হে নারদ! সেখানে কোন ধান, চাল বা অন্য কোনও অন্ন ছিল না। গৃহশূন্য দেখে মহাক্রোধে সে আমার কাছে এসে জানতে চাইল—আমি ব্রত, কৃচ্ছ্রসাধন ও উপবাসের মাধ্যমে নারায়ণের আরাধনা করেছি। এখন হে জনার্দন! আমার গৃহে কিছুই দেখছি না কেন?
হে নারদ! তখন আমি তাকে বললাম — সত্য রমণী, তুমি জীবনে অনেক কিছু করলেও কাউকে কখনও অন্ন দান করো নি, পরিবর্তে ভিক্ষা হিসাবে মাটির ঢেলা দিয়েছ। একাদশীর সুফলে তুমি স্বশরীরে স্বর্গে যাত্রা করেছ, মাটির ঢেলা দানের ফলে মনোরম গৃহ পেয়েছ, অন্ন দান না করার জন্য তুমি এখানে অন্নহীন রয়েছ।
ব্রাহ্মণী নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমার চরণতলে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল — “প্রভু আমায় ক্ষমা করে দিন, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। এর উপায় আমায় বলে দিন”।
ব্রাহ্মণীর আকুল প্রার্থনায় আমার মন বিগলিত হল এবং বিহিতের উদ্দেশ্যে জানালাম “এর একটা উপায় আছে। মর্ত্যলোকের মানবী স্বশরীরে স্বর্গে এসেছে শুনে দেবতাদের পত্নীরা তোমাকে দেখতে আসবে। নিজ গৃহে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে কিন্তু তুমি দরজা খুলবে না। তুমি তাদের কাছে ষটতিলা ব্রতের পুণ্যফল প্রার্থনা করবে। যদি তারা সেই ফল প্রদানে রাজি হয়, তবেই দরজা খুলবে, অন্যথায় নয়।”
এরপর দেবপত্নীরা সেখানে এসে তার দর্শন প্রার্থনা করল। ভগবানের উপদেশ মতো ব্রাহ্মণী তাদের কাছে ষটতিলা ব্রতের পুণ্যফল প্রার্থনা করল। শেষমেশ তাদের মধ্যে এক দেবপত্নী তাঁর ষটতিলা ব্রতজনিত পুণ্যফল তাকে প্রদান করল।
তখন সেই ব্রাহ্মণী দিব্যকান্তি বিশিষ্টা হল এবং তার গৃহ ধনধান্যে ভরে গেল। দ্বার উদঘাটন করলে দেবপত্নীরা তাকে দর্শন করে বিস্মিত হলেন।
হে নারদ! অতিরিক্ত বিষয়বাসনা (সম্পদের জন্য লোভ) করা উচত নয়। বিত্ত শাঠ্যও (সম্পদের জন্য প্রতারনা করা) অকর্তব্য। নিজ সাধ্যমতো তিল, বস্ত্র ও অন্ন দান করবে। ষটতিলা ব্রতের প্রভাবে দারিদ্রতা, শারীরিক কষ্ট, দুর্ভাগ্য প্রভৃতি বিনষ্ট হয়। এই বিধি অনুসারে তিলদান করলে মানুষ অনায়াসে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়।
হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে ।
হরে রাম, হরে রাম, রাম রাম হরে হরে ।।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করুন সুখী হোন। _____শ্রীল প্রভুপাদ!
► আরও পড়ুন: একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য ও শুদ্ধভাবে একাদশী পালনের নিয়মাবলী
You must be logged in to post a comment.