Gita Jayanti Importance গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য_1

Gita Jayanti Importance || গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য

1 min


201
170 shares, 201 points

এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করেছি গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য (Gita Jayanti Importance)। গীতা জয়ন্তী হচ্ছে ভগবদ্গীতার আর্বিভাব তিথি। ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন‍্য এই তিথি পালন করা সকলেরই কর্তব্য।

মানব জীবনের সার কথাই হল ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা‘। ৫১৫৯ (৩১৩৯ খ্রীঃপূঃ নভেম্বর ০২ তারিখ শুক্রবার) বছর আগে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে তার শিষ্যরূপে অর্জুন আত্মসমর্পণ করার পর মোক্ষদা একাদশী তিথিতে অর্জুনকে উদ্দেশ‍্য করে বদ্ধজীবের উদ্ধারের জন‍্য এই পরম পবিত্র ভগবদ্গীতার দিব্য বাণী দান করেছিলেন। দেহান্তর প্রক্রিয়া, পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ সেবার প্রকৃতি এবং আত্মজ্ঞানলব্ধ মানুষের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন।

গীতা জয়ন্তী (Gita Jayanti)চ্ছে ভগবদ্গীতার আর্বিভাব তিথি। 

গীতার বাণী শুধুমাত্র হিন্দু বা ভারতীয়দের জন্য প্রদত্ত হয়নি। এই বাণী সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রদত্ত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে মহান জ্ঞানী ও পণ্ডিতবর্গ সমস্যার সম্মুখীন হয়ে এই জ্ঞানরূপী মুক্তার নিকট আশ্রয় খুঁজেছেন। বিশ্বখ্যাত নেতৃবর্গ যথা গান্ধী, চার্চিল, আইনস্টাইন, নিউটন এবং অন্যান্য বহুজন এই জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে ভগবদ্গীতার দিব্য বাণী প্রদানের প্রেক্ষাপটটি ছিল অভূতপূর্ব। লক্ষ লক্ষ বীর পাণ্ডব ও কৌরব যোদ্ধা কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে সমবেত হয়েছিল। উভয়পক্ষের সেনাই প্রাণদান করতে এবং প্রাণ নেওয়ার জন্য তৈরি ছিল।

কিন্তু যুদ্ধ শুরুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই অর্জুন সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তিনি জীবনের সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধটি করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পলায়ন করে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করতে চাইলেন। কিন্তু অর্জুন ছিলেন ভাগ্যবান, কারন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সাথে আছেন। শ্রীকৃষ্ণ তার সখা, পথপ্রদর্শক এবং তত্ত্বজ্ঞানদ্রষ্টা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোদ্ধা যিনি তার জীবনে বহু যুদ্ধ জয় করেছেন তিনি শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হলেন। অশ্রুসজল চক্ষে, ভীতিপূর্ণ হৃদয়ে এবং কম্পিত কণ্ঠে যথার্থ মার্গপ্রদর্শনের জন্য তিনি শ্রীকৃষ্ণের সহায়তা প্রার্থনা করলেন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ২য় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোকে অর্জুন সমর্পণ করলেন ভগবানের কাছে-

কার্পণ্য দোষ উপহত স্বভাবঃ

পৃচ্ছামি ত্বাম্ ধর্ম সম্মূঢ় চেতাঃ ।

যৎ শ্রেয়ঃ স্যাৎ নিশ্চিতম ব্রূহি তৎ মে

শিষ্যঃ তে অহম্ শাধি মাম্  ত্বাম্‌ প্রপন্নম্ ।।

অনুবাদ : “কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়, তা আমাকে বল। এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও।” ─── (ভগবদ্গীতা ২।৭)

শ্রীকৃষ্ণ সকলের শুভাকাঙ্ক্ষী সুহৃদ। যারা তাঁর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন তিনি সেই সকল ভক্তের সর্বদা সহায়তা করেন। তাঁর ভক্তদের প্রতি তিনি বিশেষ কৃপা প্রদর্শন করেন। সেইজন্য অর্জুন যখন শ্রীকৃষ্ণের নিকট সহায়তা প্রার্থনা করলেন, শ্রীকৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ অর্জুনকে সহায়তা করতে অগ্রসর হলেন। অর্জুনের বিমূঢ়তার মূল কারণ তার হৃদয়ের অন্ধকারকে তিনি দূরীভূত করে দিলেন।

■ সকল বেদের জ্ঞাতব্য বিষয় শ্রীকৃষ্ণ ■ 

ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ পাঁচটি বিশেষ বিষয়ের কথা বলেছেন — ভগবান, জীব, প্রকৃতি, কালকর্ম। শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১০ম অধ্যায়ের ৮ম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পরিচয় প্রকাশ করছেন যে তিনিই পরমেশ্বর ভগবান

অহম্ সর্বস্য প্ৰভবো মত্তঃ সর্বম্‌ প্রবর্ততে। 

ইতি মত্বা ভজন্তে মাম্‌ বুধাঃ ভাবসমন্বিতাঃ ॥ 

অনুবাদঃ “আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস। সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়। সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন।” ─── (ভগবদ্গীতা ১০।৮)

শ্রীকৃষ্ণকে জানাই হল বৈদিক শাস্ত্রের উদ্দেশ্য “বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যো” অর্থাৎ “কৃষ্ণই সমস্ত বেদের জ্ঞাতব্য”। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের প্রকৃত পরিচয়ও প্রকাশ করেছেন যে, আমরা আত্মা এবং শ্রীকৃষ্ণের অংশ। আমাদের এই পরিচয় আমরা একবার উপলব্ধি করে যদি শ্রীকৃষ্ণের সাথে আমাদের সম্বন্ধ উন্নতি করতে সচেষ্ট হই তাহলে আমাদের জীবনের সব সমস্যারই অবসান ঘটবে।

Gita Jayanti Importance গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য_3

■ সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের কথা চিন্তন করে নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করা ■ 

শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা কর্তব্যকর্ম, বিকর্ম এবং নিষ্ক্রিয়কর্ম সম্বন্ধে বলেছেন। কর্তব্যকর্ম হল সেই সকল কর্ম যা একজন শাস্ত্রমেনে কর্ম সম্পাদন করে। বিকর্ম হল সেই সকল কর্ম যা শাস্ত্রে উল্লেখিত নেই অর্থাৎ শাস্ত্র বহির্ভূত কর্ম। এবং নিষ্ক্রিয় কর্ম হল কোন প্রকারের কর্তব্যকর্ম না করা। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ প্রদান করছেন যে ফলের প্রতি কোন আসক্তি না রেখে সর্বদা তাঁকে কেন্দ্রে রেখে যেন তিনি তার কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করেন।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৮ম অধ্যায়ের ৭ম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন —

তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মাম্‌ অনুস্মর যুধ্য চ। 

ময়ি অর্পিত মনঃ বুদ্ধিঃ মাম্ এব এষ্যসি অসংশয়ঃ ৷৷ 

অনুবাদঃ “অতএব হে অর্জুন, সর্বদা আমাকে স্মরণ করে তোমার স্বভাববিহিত যুদ্ধ কর। এভাবে আমাতে তোমার মন ও বুদ্ধি অর্পণ করে নিঃসন্দেহে তুমি আমাকেই লাভ করবে।” ─── (ভগবদ্গীতা ৮।৭)

যদি আমরা সর্বদা শ্রীকৃষ্ণকে আমাদের জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করে আমাদের সকল কর্ম সম্পাদন করি তাহলে আমরা এই পৃথিবীতে আনন্দে বাস করব এবং এই দেহ ও জগত ত্যাগের পর আমরা জন্ম, মৃত্যু, জরা এবং ব্যাধিরহিত শ্রীকৃষ্ণের ধামে (গোলক বৃন্দাবন) গমন করে শ্রীকৃষ্ণকে প্রাপ্ত হব।

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৮শ অধ্যায়ের ৬৬ তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যারা তাঁর শরণে আসেন তাদের কোন ভয় নেই, পাপ থেকে মুক্তি করে উদ্ধারের দায়িত্ব তাঁর।

সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকম্‌ শরণম্‌ ব্রজ ।

অহম্‌ ত্বাম্‌ সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ৷৷ 

অনুবাদঃ “সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।” ─── (ভগবদ্গীতা ১৮।৬৬)

গীতার এই দিব্যবাণী শ্রবণ করে অর্জুনের মোহ দূরীভূত হল এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণের আদেশানুসারে কর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৮শ অধ্যায়ের ৭৩ তম শ্লোকে — 

অর্জুন উবাচ

নষ্টো মোহঃ স্মৃতিঃ লব্ধা তৎপ্রসাদাৎ ময়া অচ্যুত ৷

স্থিতঃ অস্মি গত সন্দেহঃ করিষ্যে বচনম্‌ তব ৷৷ 

অনুবাদঃ “অর্জুন বললেন — প্রিয় কৃষ্ণ, হে অচ্যুত, তোমার কৃপায় আমার মোহ দূর হয়েছে এবং আমি স্মৃতিলাভ করেছি। আমার সমস্ত সন্দেহ দূর হয়েছে এবং যথাজ্ঞানে অবস্থিত হয়েছি। এখন আমি তোমার আদেশ পালন করবো।” ───  (ভগবদ্গীতা ১৮।৭৩)

■ ভগবদ্গীতা হল রাজবিদ্যা ■ 

গীতা হল বৈদিক শাস্ত্রের সর্বোত্তম রত্ন। একে বলা হয় রাজবিদ্যা—সকল বিদ্যার রাজা। শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৯ম অধ্যায়ের ২য় শ্লোকে ভগবদ্গীতার মহিমাকীর্তন করে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন — 

রাজবিদ্যা রাজগুহ্যম্ পবিত্রম্ ইদম্ উত্তমম্ ।

প্রত্যক্ষ অবগমম্ ধর্ম্যম্ সুসুখম্ কর্তুম্‌ অব্যয়ম্ ॥

অনুবাদঃ “এই জ্ঞান সমস্ত বিদ্যার রাজা, সমস্ত গুহ্য তত্ত্ব থেকেও গুহ্যতর, অতি পবিত্র এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির দ্বারা আত্মোপলব্ধি প্রদান করে বলে প্রকৃত ধর্ম। এই জ্ঞান অব্যয় এবং সুখসাধ্য।” ─── (ভগবদ্গীতা ৯।২)

সকল বৈদিক শাস্ত্র যদি গাভী হয় তাহলে ভগবদ্গীতা হল সেই গোদুগ্ধ অর্থাৎ এটি হল সকল বৈদিক শাস্ত্রের সারাতিসার। শ্রীকৃষ্ণ হলেন দুগ্ধদোহনকারী, অর্জুন গোবৎসের ন্যায় সেই দুগ্ধপান করছেন। মহামুনি ব্যাসদেব কর্তৃক লিখিত আকারে সেই দুগ্ধ আমাদের নিকট বর্তমানে সহজলভ্য হয়েছে।

চিন্ময় জ্ঞানে সমৃদ্ধ এই পবিত্র গ্রন্থ প্রতি যুগের মানুষের চেতনা বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। গীতার মাহাত্ম্য গীতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে যা সমস্ত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ, কাল ইত্যাদির কৃত্রিম সীমাকে অতিক্রম করে যায়। ভগবদ্গীতা শুধুমাত্র ৫১৫৯ বৎসরের প্রাচীন নয়, এটি সৃষ্টির ঊষাকাল থেকেই বিদ্যমান। শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১ম শ্লোকে — 

শ্রীভগবানউবাচ

ইমম্‌ বিবস্বতে যোগম্‌ প্রোক্তবান্ অহম্ অব্যয়ম্ ।

বিবস্বান্‌ মনবে প্রাহ মনুঃ ইক্ষাকবে অব্রবীৎ॥

অনুবাদঃ “পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন — আমি পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে এই অব্যয় জ্ঞানযোগ বলেছিলাম। বিবস্বান তা মানবজাতির জনক মনুকে বলেছিলেন এবং মনু তা ইক্ষাকুকে বলেছিলেন।” ─── (ভগবদ্গীতা ৪।১)

কালের প্রভাবে এই জ্ঞান লুপ্ত হওয়ায় ফলে আমাদের কল্যাণের জন্য শ্রীকৃষ্ণ পুনরায় অর্জুনকে এই জ্ঞান প্রদান করেন। 

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ২য় শ্লোকে ভগবান তা উল্লেখ করেছেন — 

এবম্‌ পরম্পরা প্রাপ্তম্ ইমম্ রাজর্ষয়ো বিদুঃ।

সঃ কালেন ইহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ ৷৷

অনুবাদঃহে পরন্তপ, এভাবেই পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত এই পরম বিজ্ঞান রাজর্ষিরা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রভাবে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল এবং তাই সেই যোগ নষ্টপ্রায় হয়েছে।” ─── (ভগবদ্গীতা ৪।২)

Gita Jayanti Importance গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য_2

■ কেন গীতা জ্ঞান ভগবান অর্জুনকে দিয়েছিলেন? ■

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ৩য় শ্লোকে ভগবান বলেছেন —

সঃ এব অয়ম্ ময়া তে অদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ ৷

ভক্তঃ অসি মে সখা চ ইতি রহস্যম্ হি এতৎ উত্তমম্ ৷৷

অনুবাদঃ “সেই সনাতন যোগ আজ আমি তোমাকে বললাম, কারণ তুমি আমার ভক্ত ও সখা এবং তাই তুমি এই বিজ্ঞানের অতি গূঢ় রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।” ─── (ভগবদ্গীতা ৪।৩)

মানবসমাজে দুই রকমের মানুষ আছে, তারা হচ্ছে ভক্তঅসুর! ভগবান অর্জুনকে ভগবদ্গীতা দান করতে মনস্থ করেছিলেন, কারণ অর্জুন ছিলেন তাঁর শুদ্ধ ভক্ত। কিন্তু অসুরদের পক্ষে এই রহস্যাবৃত জ্ঞানের মর্মার্থ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বরং তারা শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে মানতে চায় না, তারা নানা রকম জল্পনাকল্পনা করে, ভুল তথ্য প্রচার করে শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা থেকে সাধারণ পাঠককে পথভ্রষ্ট করে।

অন্যদিকে, অর্জুন বিনা দ্বিধায় শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবানরূপে স্বীকার করেছেন, তিনি সাত্বিক। তিনি শ্রীকৃষ্ণের দিব্যস্তর সম্বন্ধে কোন সংশয় পোষণ করেন না। তাই আমাদের পরস্পরার ধারায় অর্জুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই মহান বিজ্ঞানের মাধ্যমে যথার্থ মঙ্গললাভের জন্য চেষ্টা করা উচিত।

অসুরেরা শ্রীকৃষ্ণকে জড় প্রকৃতির গুণের অধীন একজন সাধারণ মানুষ বলে মনে করে, তাদের সেই অবিশ্বাসজনিত নিরীশ্বরবাদ খণ্ডন করার উদ্দেশ্যেই অর্জুনের মতো শুদ্ধ ভক্তের মাধ্যমে ভগবান আমাদের জ্ঞান লাভ করতে উদ্যত হয়েছেন। অসুর, ভগবদ্বিদ্বেষী, যারা মনে করে ভগবান একজন সাধারণ মানুষ, তারাও হয়তো এভাবে শ্রীকৃষ্ণের লীলা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণকে একজন অতিমানবিক, সচ্চিদানন্দময় রূপসম্পন্ন, অপ্রাকৃত, মায়াতীত, গুণাতীত ও কালাতীত বলে বুঝতে পারবে। 

■ ভগবদ্গীতা যুগ যুগ ধরে মানবতাকে আলোকিত করছে ■

গীতার বাণী শুধুমাত্র হিন্দু বা ভারতীয়দের জন্য প্রদত্ত হয়নি। এই বাণী সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রদত্ত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে মহান জ্ঞানী ও পণ্ডিতবর্গ। স্যার সম্মুখীন হয়ে এই জ্ঞানরূপী মুক্তার নিকট আশ্রয় খুঁজেছেন। বিশ্বখ্যাত নেতৃবর্গ যথা গান্ধী, চার্চিল, আইনস্টাইন, নিউটন এবং অন্যান্য বহুজন এই জ্ঞানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ভগবদ্গীতা পাঠের পর একজন হিন্দু উন্নততর হিন্দু হবেন, একজন মুসলমান উন্নততর মুসলমান হবেন, একজন খ্রিষ্টান উন্নতর খ্রিষ্টান হবেন এবং একজন ইহুদী উন্নতর ইহুদী হবেন। সমগ্র পৃথিবীতে ভগবদ্গীতার উপর শ্রীল প্রভুপাদের তাৎপর্য সমন্বিত “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ” ভগবদ্গীতার সর্বাধিক বিক্রীত সংস্করণ। ১০০ লক্ষেরও অধিক “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ” গ্রন্থ বিক্রি হয়েছে এবং এই গ্রন্থ ৮০টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

আমরা গীতা জয়ন্তী উৎসব তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করি যে তিনি যেন আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেন যাতে আমরা তাঁকে উপলব্ধি করে ভালোবাসতে পারি। আসুন আমরা অর্জুনের নিকট প্রার্থনা করি যেন আমরাও তাঁর ন্যায় শ্রীকৃষ্ণের নিকট পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে পারি।

■ ভগবদ্গীতা সর্ম্পকে কিছু বহিরঙ্গা জ্ঞান ■ 

১। গীতা হচ্ছে সমস্ত শাস্ত্রের সারতিসার। এমনকি গীতায় এমন কিছু আছে যা অন্যান্য কোন শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। যেমন – ৫ম পুরুষার্থ।

২। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের ২৫ থেকে ৪২ নং অধ্যায়ের এই ১৮ টি অধ্যায় হল ভগবদগীতা বা গীতোপনিষদ

৩। গীতায় আছে ৭০০ শ্লোক – তার মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন ১টি শ্লোক, সঞ্জয় বলেছেন ৪০টি শ্লোক, অর্জুন বলেছেন ৮৫টি শ্লোক, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ৫৭৪টি শ্লোক । আর পুরো গীতায় ৯৫৮০ টি সংস্কৃত শব্দ আছে ।

৪। গীতার ১৮টি অধ্যায় হল যথাক্রমেঃ

● ১ম (প্রথম) অধ্যায় —  বিষাদযোগ

● ২য় ( দ্বিতীয়) অধ্যায় — সাংখ্যযোগ

● ৩য় (তৃতীয়) অধ্যায় — কর্মযোগ

● ৪র্থ (চতুর্থ) অধ্যা)য় — জ্ঞানযোগ

● ৫ম (পঞ্চম) অধ্যায় — কর্মসন্ন্যাসযোগ

● ৬ষ্ঠ (ষষ্ঠ) অধ্যায় — ধ্যানযোগ

● ৭ম (সপ্তম) অধ্যায় — বিজ্ঞানযোগ

● ৮ম (অষ্টম) অধ্যায় — অক্ষরব্রহ্মযোগ

● ৯ম (নবম) অধ্যায় — রাজগুহ্যযোগ

● ১০ম (দশম) অধ্যায় — বিভূতিযোগ

● ১১শ (একাদশ) অধ্যায় — বিশ্বরূপদর্শনযোগ

● ১২শ (দ্বাদশ) অধ্যায় — ভক্তিযোগ

● ১৩শ (ত্রয়োদশ) অধ্যায় — প্রকৃতিপুরুষবিবেকযোগ

● ১৪শ (চতুর্দশ) অধ্যায় — গুণত্রয়বিভাগযোগ

● ১৫শ (পঞ্চদশ) অধ্যায় — পুরুষোত্তমযোগ

● ১৬শ (ষোড়শ) অধ্যায় — দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ

● ১৭শ (সপ্তদশ) অধ্যায় — শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ

● ১৮শ (অষ্টাদশ) অধ্যায় — মোক্ষযোগ

৪। গীতার ১৮টি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ৬টি অধ্যায়কে বলে কর্মষটক, মাঝখানের ৬টি অধ্যায়কে বলে ভক্তিষটক, আর বাকি ৬টি অধ্যায়কে বলে জ্ঞানষটক

৫। গীতা পড়লে ৫টি জিনিষ সর্ম্পকে জ্ঞান লাভ হয় – ঈশ্বর, জীব, প্রকৃতি, কালকর্ম

৬। যদিও গীতার জ্ঞান ৫১৫৯ বছর আগে বলেছিলেন কিন্তু ভগবান চতুর্থ অধ্যায়ে বলেছেন এই জ্ঞান তিনি এর আগেও বলেছেন, মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৪৮/৫২-৫২) গীতার ইতিহাস উল্লেখ আছে । তার মানে গীতা প্রথমে বলা হয় ১২,০৪,০০,০০০ বছর আগে, মানব সমাজে এই জ্ঞান প্রায় ২০,০০,০০০ বছর ধরে বর্তমান, কিন্তু কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেলে পুনরায় আবার তা শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দেন ।

তাই, এই গীতা জয়ন্তীতে বেশি বেশি করে গীতা পাঠ, গীতা মহিমা শ্রবণ, গীতা দান করুন।

● তবে দান নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ দান হওয়া উচিত। তাই আমরা যদি গীতা জয়ন্তীতে গীতা দান করি তাহলে অবশ্যই সেই দান সর্বশ্রেষ্ঠ দান হবে।

● গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, উপযুক্ত সময়ে দান করা উচিত!!

শ্রীমদ্ভগবদগীতার ১৭শ অধ্যায়ের ২০ নং শ্লোকে তা উল্লেখ আছে –

দাতব্যম্ ইতি যৎ দানম্ দীয়তে অনুপকারিণে। 

দেশে কালে  চ পাত্রে চ তৎ দানম্ সাত্ত্বিকম্ স্মৃতম্ ।।

অনুবাদঃ “দান করা কর্তব্য বলে মনে করে এবং প্রত্যুপকারের আশা না করে উপযুক্ত স্থানে, উপযুক্ত সময়ে এবং উপযুক্ত পাত্রে যে দান করা হয়, তাকে সাত্ত্বিক দান বলা হয়।” ─── (গীতা- ১৭/২০)

Gita Jayanti Importance গীতা জয়ন্তী মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য_4

■ শ্রীমদ্ভগবদগীতার জ্ঞান কাউকে দান বা প্রচার করলে কি লাভ হয়?

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন,

🌀১/

যঃ ইদম্ পরমম্ গুহ্যম্ মৎ ভক্তেষু অভিধাস্যতি ৷

ভক্তিম্ ময়ি পরাম্‌ কৃত্বা মাম্ এব এষ্যতি অসংশয়ঃ ৷৷

অনুবাদঃ যিনি আমার ভক্তদের মধ্যে এ পরম গোপনীয় গীতাবাক্য উপদেশ দান করলে, তিনি অবশ্যই পরাভক্তি লাভ করে নিঃসন্দেহে আমার কাছে ফিরে আসবেন। ─── (ভগবদ্গীতা-১৮/৬৮)।

🌀২/

ন চ তস্মাৎ মনুষ্যেষু কশ্চিৎ মে প্রিয়কৃত্তমঃ ৷

ভবিতা ন চ মে তস্মাৎ অন্যঃ প্রিয়তরঃ ভুবি ৷৷

অনুবাদঃ এ পৃথিবীতে মানুষের মতো তাঁর থেকে অধিক প্রিয়কারী আমার আর কেউ নেই এবং তার চেয়ে অন্য কেউ আমার প্রিয়তর কেউ হবে না।  ─── (ভগবদ্গীতা-১৮/৬৯)।

Read-More_4

আরও পড়ুন: ভগবান “শ্রীকৃষ্ণের অবতরন”-এর উদ্দেশ্য কি?

আরও পড়ুন: মহাভারতে অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের পরম শিক্ষা || ইসকন

আরও পড়ুন: ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ১০টি প্রতিজ্ঞা মানুষের মুক্তির উদ্দেশ্যে

আরও পড়ুন: ৩৫টি মহাভারতের রহস্যময় অজানা তথ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বাণী ||ইসকন

আরও পড়ুন: হিন্দু ধর্মের যুগ বিভাগ ~ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ

x

Like it? Share with your friends!

201
170 shares, 201 points

Thanks for your interest joining to Bangla Kobita Club community.

Something went wrong.

Subscribe to Join Our Community List

Community grow with You. [Verify and Confirm your Email]